কতটা তেল আছে রাখাইনে?

জাতিসঙ্ঘ চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করেছে মিয়ানমারে এখন রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যা ঘটছে, তা হচ্ছে এথনিক ক্লিনসিং তথা জাতিগত নিধন অভিযান। জাতিসঙ্ঘের এই বক্তব্যের পর মনে হয় ‘মহান মানবতাবাদী’ অং সান সু চির ন্যায়পরায়ণতা তথা সাধুতার মুখোশ খসে পড়েছে। মিয়ানমারে বর্বরতার শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য সু চি এমনকি সমবেদনা জানানোর জন্য কয়েকটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করার নৈতিক সাহস দেখাতে পারেননি। এর পরিবর্তে তিনি অন্তত বলতে পারতেন : ‘যারা আমাদের দেশে আছে তাদের সবার প্রতি আমাদের যত্ন নিতে হবে।’

এ দিকে তার মুখপাত্র এবং অন্য প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের নিজেদের গ্রামে অগ্নিসংযোগ বা আগুন লাগিয়ে দেয়া ও তাদের মিথ্যা নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করার মাধ্যমে নিজেদের নীচ ও হীন করার জন্য দায়ী করেন। কিন্তু সঠিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আমাদের কাছে যেসব রিপোর্ট বা সংবাদ দেয়া হচ্ছে, তা রোহিঙ্গারা বাস্তবে যে কঠিন ও নৃশংস অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন তার চেয়েও বেশি কষ্টকর ও যন্ত্রণাদায়ক।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে দুঃস্বপ্নের যাত্রা শেষে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের নৃশংসভাবে হত্যা, নারীদের নির্যাতন এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার লোমহর্ষক বর্ণনা দিচ্ছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ধারণ করা যেসব ছবি সরবরাহ করেছে তাতে এই বর্বতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ছবিতে দেখা যায়, রাজ্যব্যাপী গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গাদের জন্য ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাস নতুন কিছু নয়। কিন্তু বিশেষভাবে জরুরি বিষয় হলো, পশ্চিমারা এখনো যে সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতা চালাচ্ছে, সম্পূর্ণভাবে তাদের পক্ষে রয়েছে। আর এর কারণ হলো তেল।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে পশ্চিমা বিশ্ব বয়কট করার কারণে সেখানে ব্যাপক তেল মজুদের বিরুদ্ধে বাধা আসেনি। এখন পশ্চিমারা সেই তেল উত্তোলনের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতা। সেখানে অনেকটা হঠাৎ করেই মূল্যবান খনিজ পদার্থ আবিষ্কৃত হয়েছে। সব দেশকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। শেল, ইএনআই, টোটাল, শেভরন এবং অন্যান্য কোম্পানি সেখানে বিশাল আকারের পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। অপর দিকে চীনকে ধীরে ধীরে ঠেলে বের করে দেয়া হচ্ছে; অথচ চীন মিয়ানমারের অর্থনীতিতে বহু বছর ধরে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে।

এশিয়ায় চীনের সুপার পাওয়ারের মর্যাদাকে হেয়প্রতিপন্ন করে প্রয়োজনে পশ্চিমারা সু চিকে মিয়ানমারের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু মৌলিকভাবে মিয়ানমারে কখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি; বরং বিপুল পরিমাণ তেল সম্পদ অর্জনের দিকে ফিরে যাওয়ার পথ সুগম করার লক্ষ্যেই কেবল মিয়ানমারকে আবার চিহ্নিত করা হয়েছে। যাই হোক না কেন, রোহিঙ্গাদেরই এর জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে। মিয়ানমারের সরকারি অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। রোহিঙ্গারা বিদেশী, অনুপ্রবেশকারী অথবা অভিবাসী নয়। অষ্টম শতাব্দী থেকে তারা তাদের রাজ্য আরাকানে বসবাস করে আসছে। তারা আরব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ইসলামের শিক্ষা বা আলো পেয়েছে। সেখান থেকেই তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরাকান একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পরিণত হয়।

আরাকান হচ্ছে মিয়ানমারের আধুনিককালের রাখাইন রাজ্য। সেখানে এখনো ১২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের বসবাস। রোহিঙ্গারা বহিরাগত- এই প্রচারণা শুরু করা হয় ১৭৮৪ সালে। ওই সময় বর্মি রাজা আরাকান জয় করেন এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন।

রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা এবং তাদের রাখাইন রাজ্য থেকে বের করে দেয়ার অবিরাম প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ১৯৪২ সালে ও ১৯৪৮ সালে জাপানিরা ব্রিটিশ বাহিনীকে বার্মায় পরাজিত করার পর এসব ঘটনা ঘটে। ১৯৬২ ও ১৯৭৭ সালে বার্মার সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর সামরিক জান্তা দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। ১৯৮২ সালে সামরিক জান্তা একটি আইন পাস করে বেশির ভাগ রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় এবং তাদের নিজের দেশে অবৈধ বলে ঘোষণা করে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ২০১২ সালে সঙ্ঘাত শুরু হয়। তখন থেকে প্রতিটি উপাখ্যান একেকটি আদর্শ নজির হয়ে রয়েছে।

বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করা হয় এবং বনজঙ্গলের দিকে জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর যারা বেঁচে যায় তাদের শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক নীরবতার মধ্যে পোপ ফ্রান্সিসের মতো কেবল গুটিকয়েক সম্মানিত ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের সমর্থনে কথা বলেছেন। পোপ গত ফেব্রুয়ারি মাসে গভীর অভিনিবেশসহকারে প্রার্থনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তারা ভালো মানুষ। তারা শান্তিকামী মানুষ এবং তারা আমাদের ভাই-বোন।’ কিন্তু তার ন্যায়বিচারের আহ্বানের প্রতি কখনোই গুরুত্ব দেয়া হয়নি।

অপর দিকে আরব ও মুসলিম দেশগুলো নীরবতা পালন করছে। গণহত্যা অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দাবি ওঠা সত্ত্বেও মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের দূতদের মাধ্যমে অকাট্য সত্য সম্পর্কে ভালোভাবে জানার পরও যেকোনোভাবে সেগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানি করপোরেশনগুলো মিয়ানমারের সম্পদের সুযোগ নেয়ার জন্য যখন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে, তখন তাদের মার্কিন সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন প্রয়োজন। বারাক ওবামা প্রশাসন এমনকি ২০১৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে অং সান সু চি ও ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার আগেই মিয়ানমারের সুযোগ সুবিধাকে স্বাগত জানিয়েছিল। ওই সময়ের পর মিয়ানমার আমেরিকার আরেকটি সাফল্যকাহিনীতে পরিণত হয়। সত্যিকার অর্থে সেখানে বছরের পর বছর ধরে গণহত্যা চলমান রয়েছে।

মিয়ানমারের সহিংসতা সম্ভবত ছড়িয়ে পড়বে এবং আরো বিস্তার লাভ করবে। এই সহিংসতা আসিয়ানের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়বে। কারণ এসব দেশে দু’টি প্রধান জাতিগোষ্ঠীগত এবং ধর্মীয় গ্রুপ প্রভাবশালী। ইতোমধ্যে এমনকি এটা নিয়ে গ্রুপগুলোর মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে। মিয়ানমারের সম্পদের লোভে পশ্চিমাদের আনন্দচিত্তে ফিরে আসা এবং আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুতা সম্ভবত পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে। আসিয়ান দেশগুলো তাদের নীরবতার অবসান ঘটিয়ে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা বন্ধে চাপ প্রয়োগের জন্য একটি সমুদয় নীতি গ্রহণ না করলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে। সারা বিশ্বের মানুষকে অবশ্যই এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। ধর্মীয় সম্প্রদায়কে অবশ্যই কথা বলতে হবে। মানবাধিকার গ্রুপগুলোকে মিয়ানমার সরকারের অপরাধ প্রতিরোধে অবশ্যই আরো বেশি কিছু করতে হবে। আর এই সরকারের কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার সম্মানিত বিশপ ডেসমন্ড টুটু চলমান গণহত্যার ব্যাপারে অং সান সু চির অস্পষ্ট নীতির জন্য তাকে ভর্ৎসনা করেছেন।

যে ব্যক্তি তার নিজ দেশে বর্ণবৈষম্যদের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকে, আমরা ওই ব্যক্তির কাছ থেকে অন্তত কী আশা করতে পারি? আমরা ওই বিখ্যাত উক্তিটি লিখে তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারি : ‘আপনি যদি অন্যায় ও অবিচারের সময় নিরপেক্ষ থাকেন তাহলে আপনি নির্যাতনকারী ও উৎপীড়ক তথা জালেমের পক্ষাবলম্বন করলেন।’

লেখক : একজন সাংবাদিক, গ্রন্থকার ও প্যালেস্টাইন ক্রোনিকেলের সম্পাদক। তার প্রকাশিতব্য বইয়ের নাম ‘দ্য লাস্ট আর্থ : এ প্যালেস্টাইন স্টোরি’। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি প্যালেস্টাইন স্টাডির ওপর পিএইচডি নিয়েছেন।

আরব নিউজ থেকে তার বিগ অয়েল, ফেইলড ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ডস শ্যাম ইন মিয়ানমার নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন : খায়রুল বাশার