মিটিং-নিয়মনীতির তোয়াক্কা নেই

কলারোয়ার সোনাবাড়ীয়া হাইস্কুলের সভাপতির একক সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের হয়রানি

মিটিং না করে, রেজুলেশন না করে, কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়ে, লিখিত ব্যাখ্যা না নিয়ে ও শুনানি না করেই সভাপতির একক সিদ্ধান্তে সাতক্ষীরার কলারোয়ার সোনাবাড়িয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষককে নিয়ম বহির্ভূতভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া সভাপতি মাসের পর মাস মিটিং না করে ও বেতন বিলে স্বাক্ষর না করায় গত দুই মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না শিক্ষক কর্মচারীরা। আবার এনটিআরসিএ কর্তৃক সরাসরি নিয়োগ পাওয়া এক শিক্ষকের এমপিও কাগজপত্র সব ঠিকঠাক থাকলেও তাতে স্বাক্ষর না করায় ওই শিক্ষক আজও এমপিওভুক্ত হতে পারেনি, যেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার সুনির্দিষ্ট পরিপন্থী। এমনি নানান হয়রানির অভিযোগ উঠেছে স্কুলটির সভাপতি আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে যান না সভাপতি আমজাদ হোসেন। তিনি সভাপতি হওয়া পর থেকেই স্কুলের সাথে বৈরি সম্পর্ক শুরু হয়, যা এখনো দৃশ্যমান। মূলত স্কুলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের টানপোড়ের সৃষ্টি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক সদস্য মনিরুল ইসলাম, আনারুল ইসলাম ও নবীছদ্দীন বলেন, মূলত একটি নিয়োগ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে আজ এই ঘটনার আবির্ভাব। আমজাদ হোসেন গেল দেড় বছর ধরে স্কুলে আসেন না এবং কোনো মিটিংয়ের তিনি উপস্থিত থাকেন না। তিনি একা একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত করেছেন।

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির দাতা সদস্য ও বর্তমান ইউপি সদস্য নূরুল ইসলাম বলেন, “সভাপতি আমজাদ হোসেন স্কুলটি ধ্বংস করে দিলো। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির ১১ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জন সদস্য আমরা কেউ এই বরখাস্তের বিষয়ে কিছুই জানিনা। সভাপতি নিজের স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের জন্য এমনটা ঘটিয়েছেন। তিনি নিয়মনীতি ও আইনের তোয়াক্কা করেন না। নিয়োগ বাণিজ্য করতে না পারায় তিনি এমন মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলেও অভিযোগ করেন এই সদস্য।”

স্কুলের শিক্ষক প্রতিনিধি স্বপন কুমার চৌধুরী বলেন, “আমজাদ হোসেনের সভাপতি হওয়ার পর থেকে আমরা কেউ স্বস্তিতে নেই। ২ মাস ধরে আমরা বেতন তুলতে পারছি না। সভাপতি বেতন বিলে সই করছেন না। এর আগেও তিনি শিক্ষকদের বেতন আটকে দিয়েছেন, ইউএনও মহোদয়ের হস্তক্ষেপে সে সময় সেটি সুরাহ হয়। আবারও তিনি শিক্ষকদের বেতন আটকে দিয়েছেন। আমরা এর একটি সুষ্ঠু সমাধান চাই।”

এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে সদ্য নিয়োগ পাওয়া সহকারী শিক্ষক ইয়াছিন আলী বলেন, “সভাপতি আমজাদ হোসেনের কারণে আমি এখনো এমপিওভুক্ত হতে পারিনি। তিনি আমার কাগজপত্রে স্বাক্ষর করছেন না। তিনি তো স্কুলে আসেন না, আমি বারবার উনার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাইনি।”

এদিকে, ০৪/০১/২০২৪ ইং তারিখে স্বাক্ষরিত চিঠিতে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত ছাড়াও অত্র স্কুল থেকে আরেকজন শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করে আরেকটি চিঠি দেন সভাপতি। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়া সিনিয়র শিক্ষক হুমায়ূন কবীর বলেন, “আমি প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে একটি চিঠি পেয়েছি। তবে দায়িত্ব কবে পাবো জানিনা।”
জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তিনি যোগ্য না হয়ে কিভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককের দায়িত্ব পেলেন এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষক হুমায়ূন কবীর বলেন, “আসলে এটা সত্য জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে আমি যোগ্য না। তবে যারা আমার সিনিয়র শিক্ষক আছেন তারা সভাপতির বিরুদ্ধে মামলার স্বাক্ষী এজন্য সভাপতি উনাদের মনোনীত না করে আমাকে করেছেন।” কোনো মিটিং বা রেজুলেশন ছাড়াই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বের চিঠি পেয়েছেন বলেও অকপটে স্বীকার করেন এই শিক্ষক।

সোনাবাড়ীয়া সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আখতার আসাদুজ্জামান বলেন, “বরখাস্তের বিষয়ে আমি কোনো চিঠি পাইনি। বিষয়টি ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। কোনো মিটিং না করে, রেজুলেশন না করে, এভাবে কি সভাপতি একক কর্তৃত্বে বরখাস্ত করতে পারেন? ২০২২ সালের আগস্ট মাস থেকে সভাপতি স্কুলে আসেন না। নিয়োগ বাণিজ্য করতে না পেরে সভাপতি এসব করছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন।”

এদিকে সহকারী প্রধান শিক্ষক জিয়ারুল ইসলাম বলেন, “বিষয়টি ফেসবুকের মাধ্যমে আমি জেনেছি, তবে কোনো চিঠি পাইনি। সামাজিকভাবে আমাদের হেয়পতিপন্ন করার জন্য সভাপতি এসব করছেন।”

এ বিষয়ে কলারোয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ মীর মস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সভাপতি একক কর্তৃত্বে কাউকে বরখাস্ত করতে পারেন না। বরখাস্ত প্রক্রিয়া নীতিমালা বহির্ভূত হলে সেটি কার্যকর হবে না।”

সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ শাহজাহান কবীর বলেন, “সভাপতি চাইলেই যাকে তাকে বরখাস্ত করতে পারেন না। বরখাস্ত করতে হলে আগে কারণ দর্শানো নোটিশ, রেজুলেশন সহ কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। অন্যথায় সেটি কার্যকর বলে গণ্য হবে না।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার সহকারী পরিচালক এস.এম জিয়াউল হায়দার হেনরী বলেন, “কাউকে বরখাস্ত করতে হলে প্রথমে পূর্ণাঙ্গ কমিটির মিটিং-এ রেজুলেশনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত পাস করতে হবে। এরপর কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রেরণ এবং ৭ দিনের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যাদানের জন্য নোটিশ দিতে হবে। তারপর তিনি ব্যক্তিগতভাবে শুনানী দিতে চান কিনা তাও জানতে চাইতে হবে। এসব নিয়মের বাহিরে গিয়ে কাউকে বরখাস্ত করার সুযোগ নেই।”

সোনাবাড়ীয়া সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মো. আমজাদ হোসেনের কাছে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে (০১৭১৮-০০২৬৭৬) শনিবার বিকাল ৫টা ১০মিনিটে ৪ বার এবং সন্ধ্যা ৭টা ৫মিনিটে ৩বার কল দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।