কার গুলিতে প্রাণ গেল সেটা জানতেই এক বছর

সাংবাদিক শিমুল হত্যার এক বছর আজ। দীর্ঘ এক বছর কেটে গেলেও ঘটনার সময় ব্যবহৃত কিছু অবৈধ অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি। খোঁজ মেলেনি সাংবাদিক শিমুলের ব্যবহৃত ক্যামেরা ও মোবাইলের। এটাও জানা যায়নি ঠিক কোন পক্ষের গুলিতে প্রাণ গেছে শিমুলের।

সে সময় ঘটনাস্থলের কাছে শটগান হাতে শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়র হালিমুল হক মিরুর ছবি প্রকাশ পায়। শিমুল খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ও গ্রেফতারও হন তিনি। ঘটনার পর ডালপালা গজিয়েছে অনেক। কিন্তু এক বছরেও চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার বিচার শুরু না হওয়ায় সঠিক বিচার নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন নিহত সাংবাদিকের স্বজনরা।

শিমুলের মামাতো ভাই আবুল কালাম আজাদসহ স্বজনরা জানান, মামলাটি প্রথম থেকেই দ্রুত বিচার আইনে নেয়ার দাবি থাকলেও অদৃশ্য কারণে তা রয়ে গেছে সাধারণ আদালতেই। স্বজন হত্যার বিচার দেখে যেতে চান তারা। কিন্তু মামলার যে ধীরগতি তাতে তাদের জীবদ্দশায় মামলার রায় দেখে যেতে পারবেন কিনা সেটি নিয়ে তারা সন্দিহান। তবে নিহত সাংবাদিকের স্ত্রীকে চাকরি দেয়ায় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তারা।

শিমুল হত্যা মামলার আইনজীবী মো. আবুল কাশেম মিয়ার দাবি, উদ্ধার হওয়া অস্ত্র দিয়েই শিমুলকে গুলি করা হয়েছে। এখানে অভিযুক্তদের পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে জামিনে মুক্ত শিমুল হত্যা মামলার আসামি শাহেব আলী জানান, মেয়রের বাড়িতে হামলার সময় প্রতিপক্ষের গুলিতে সাংবাদিক শিমুলসহ আমরা ৪ জন আহত হয়েছিলাম। আমাদের শরীরে এখনও স্প্লিন্টার রয়েছে। আমাদের শরীরে থাকা স্প্লিন্টার আর শিমুলের মাথা থেকে পাওয়া স্প্লিন্টার মিলালেই প্রমাণিত হবে কার গুলিতে সাংবাদিক শিমুলের মৃত্যু হয়েছে।

শাহজাদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি বিমল কুমারসহ স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় বেশ কয়েকটি অস্ত্র ব্যবহৃত হলেও পুলিশ বৈধ ও অবৈধ মিলে মাত্র ২টি অস্ত্র উদ্ধার করতে পেরেছে। আর কোনো অস্ত্র পুলিশ এক বছরেও উদ্ধার করতে পারেনি।

এদিকে জামিনে মুক্ত মেয়রের ভাই হাফিজুল হক পিন্টু জানান, ঢাকায় ফরেনসিক ল্যাবরেটরির ব্যালিস্টিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শিমুলের মাথায় পাওয়া সিসার বলের ওজন ০.৫০ গ্রাম। আর মিরুর শটগানের কার্তুজের ওজন ০.৫৩ গ্রাম। তবে দুটো সিসার সাদৃশ্য রয়েছে। আর মিরুর ব্যবহৃত শটগানের সঙ্গে পাঠানো জব্দকৃত বুলেট এই শটগান থেকে ছোড়া হয়নি। তাহলে পুলিশ কিসের ভিত্তিতে মিথ্যা চার্জশিট দিলো।

তিনি আরও বলেন, দু’পক্ষের সংঘর্ষের ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে পুলিশ মামলার এজাহারের বাইরের ১৮ আসামিকে শনাক্ত করেছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেছে। তাহলে ওই ভিডিও থেকে কেন মেয়রের বাড়িতে হামলাকারীরা শনাক্ত হলো না এবং মামলাটি ফাইনাল দেয়া হলো।

এসব বিষয়ে শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম কিবরিয়া জানান, ঘটনার পরই মেয়র মিরুর লাইসেন্সকৃত শটগান ও গুলি জব্দ এবং তার ভাই মিন্টুর তথ্যমতে একটি পাইপগান উদ্ধার করা হয়। এর বাইরে আর কোনো অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা তা তিনি জানেন না।

তিনি আরও জানান, শিমুলের স্ত্রী ও বিজয়ের বাবার মামলায় ২৯ আসামি জামিনে রয়েছেন, পলাতক রয়েছেন আটজন। পুলিশ এজাহারভুক্ত ১৮ জনসহ মোট ৩৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে পৃথক দুইটি অভিযোগপত্র দাখিল করেছে।

উল্লেখ্য গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন সমকাল পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় নেয়ার পথে পরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় তার। এ ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে শাহজাদপুরসহ সারাদেশ। পরপর ৩টি পক্ষ থেকে মামলাও হয়।

অভিযোগ রয়েছে, পূর্ব শক্রতার জের ধরে মেয়রের ভাই হাফিজুল হক পিন্টুর নেতৃত্বে ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ছাত্রলীগ নেতা বিজয় মাহমুদকে ধরে নিয়ে মেয়রের বাড়িতে আটকে রেখে মারপিট করে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে কিছুক্ষণ পরই আওয়ামী লীগের একটি অংশ মহাসড়ক অবরোধ করে। এরপর অবরোধকারীদের একটি অংশ মেয়রের বাড়িতে হামলা করতে যায়। এক পর্যায়ে মেয়রের বাড়ির অদূরে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।

সেসময় মেয়র মিরু দাবি করেছিলেন, হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে তার লাইসেন্সকৃত শটগান থেকে তিনি বাড়ির ভেতর থেকে একটি গুলি করেছিলেন। সংঘর্ষের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, মেয়র তার বাড়ির সামনে অস্ত্র হাতে পায়চারি করছেন। আর সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আহত সাংবাদিক শিমুলকে উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছে অন্যরা। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় নেয়ার পথে পরের দিন মারা যান শিমুল।

এ ঘটনায় সাংবাদিকের স্ত্রী নুরুন্নাহার খাতুন বাদী হয়ে মেয়র মিরু, তার ভাই মিন্টুসহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে মামলা করেন। প্রায় একই আসামিদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন ছাত্রলীগ নেতা বিজয় মাহমুদের বাবা এরশাদ আলী। এ ২টি মামলায় মেয়র মিরু এখনও জেলহাজতে রয়েছেন। মিরুকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম সেসময় দাবি করেছিলেন, ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজ দেখে তিনি এজাহারভুক্ত আসামির বাইরের ১৮ আসামিকে শনাক্ত করেছেন। গত বছর অভিযোগপত্র দেয়ার পরই তিনি বদলি হন।

অপরদিকে ঘটনার দুই মাসেও থানায় মামলা না নেয়ায় মিরুর স্ত্রী লুৎফুননেছা পিয়ারী বাদী হয়ে আদালতে একটি মামলা করেন। এ মামলায় ১৯ আসামির মধ্যে রয়েছেন শাহজাদপুর পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র নাসির উদ্দিন, পৌর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক ভিপি আব্দুর রহিম, আমিরুল ইসলাম সাহু, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ কাজল, স্থানীয় সাংসদ হাসিবুর রহমান স্বপনের ব্যক্তিগত সহকারী আশিকুল হক দিনার ও সাংসদের ভাগ্নে মিঠু। কিন্তু পুলিশ তদন্ত শেষে সকল আসামিকে বাদ দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। সেসময় বাদী নারাজি দিয়ে মামলাটির জুডিশিয়াল তদন্ত দাবি করেন। এরপর জুডিশিয়াল তদন্তে দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনের দুটি ধারায় প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় শাহজাদপুর আমলী আদালত ও সিরাজগঞ্জ স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলাটির বিচারকাজ চলছে।