খদ্দেরের জন্যই শাঁখা-সিঁদুরে সাজেন নাসিমা

সায়েম সাবু : খয়ের-জর্দা মাখা পান মুখে ভরা। পানের ছোবরা জিহ্বার ডগায় এ গাল থেকে ও গালে ঠেলছেন। শ্যামলা ঠোঁটেও গাঢ় লাল বেয়ে পড়ছে যেন। রাঙা ঠোঁটের সঙ্গে খয়ের-জর্দার ঘ্রাণও সুবাসিত করছিল বেশ।

ঘরের পেছন আঙিনা ঘেঁষে শান বাঁধা। তাতে এক পা তুলে বসে আরেক পা দোলাচ্ছেন। দুলছেন নিজেও। ঘর থেকে মৃদুস্বরে ভেসে আসছে পুরনো দিনের গান। মোবাইলের মেমোরিতে থাকলেও সাউন্ড বক্সের সংযোজনে সুরের বিশেষ আবহ তৈরি করছে।

মোহাম্মদ রাফির কণ্ঠে উর্দু গজল, জগজিৎ সিংয়ের কণ্ঠে হিন্দি গজল, আবার বাংলাদেশের বাউল শিল্পী আকলিমার কণ্ঠে বিচ্ছেদ গানের পসরা নিয়ে বসেছেন। গলি মুখের ডিস্কো গান নাসিমাতে এসে ম্লান হয়ে যাচ্ছে হারানো দিনের সুরে সুরে।

দৌলতদিয়া নিষিদ্ধপল্লীর মধ্যখানের কাজীর হোটেল থেকে দখিনের গলিতে কয়েক কদম গেলেই নাসিমার ঘর। ঘরের সামনে গলি পথেই পান-সিগারেটের দোকান। সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা দোকানিই পানের যোগান দেন এ গলিতে। গলির বেশিরভাগ জুড়েই আলো-আঁধারের মিতালি।

নাসিমা যেখানে বসেন, সেখানে দোকানের খানিক আলো গিয়ে ঠেকছে। আর সে আলোতেই খদ্দেরের নজর কাড়ছেন নাসিমা। লাল টুকটুকে ব্লাউজের পেছন ভাগে ফিতা বাঁধা। হালকা সবুজ শাড়ির পাড় একেবারে লালে লাল। শাড়ির আঁচল জাগাতেই হাতে ধবধবে সাদা শাঁখা ঝলক দিয়ে উঠল। ঝলক দিল কপালের সিঁদুরও।

পান খাওয়ার ছুতোয় গল্প শুরু। দিনক্ষণ মনে না থাকলেও বছর বিশেক হয়েছে এ পেশায় আসা তিনি। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। পটুয়াখালী শহরে নিষিদ্ধপল্লীতেও বাড়ি আছে তার। মা গত হয়েছেন নাসিমার শৈশবেই। ভাই নেশায় আসক্ত।

বড় বোন আরও আগেই এ পেশায় এসেছেন। সেও দৌলতদিয়া নিষিদ্ধপল্লীতে কাজ করেন। মূলত বড় বোনের হাত ধরেই এ পেশায় আসা। দৌলতদিয়া পল্লীতেও জায়গা কিনেছিলেন। পেশায় ইতি টানবেন বলে কিছুদিন আগে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন।

আলাপেই মজে থাকলেন ঘণ্টা খানেক। ছবি তোলাতেও আপত্তি জানালেন না। বরং পরিপাটি হয়ে সহযোগিতাই করলেন। আয়নায় রূপ রেখে যখন সাজছিলেন নাসিমা, সে বেলাতেই আরেক রূপের খবর দিলেন।

বহুদিনের পুরনো দুই খদ্দেরের জন্যই শাঁখা-সিঁদুরে সাজেন। বন্ধু দু’জনই হিন্দু সম্প্রদায়ের। একজন ঢাকা থেকে আসেন, আরেকজন মানিকগঞ্জ। তবে এ দুই খদ্দের নাসিমার জন্য কেবলই খদ্দের নয়। জীবনের বন্ধু বনে ঠাঁই দিয়েছেন দৌলতদিয়া নিষিদ্ধপল্লীর খুপরি ঘরে। পেশার বাইরে গিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন নিজের অন্ধকার জীবনের ব্যক্তিগত গল্পে।

এ দুই বন্ধুর একজন বৃহস্পতিবার ঘরে এলে, আরেকজন আসেন শুক্রবার। তবে কখনই নাকি মুখোমুখি হয়নি দু’জনে। এ দু’দিন অন্য খদ্দের ঘরে আনতে মানা। দু’জনের কাছ থেকে বকশিশও পান বেশ। পটুয়াখালীর গ্রামে যে বাড়ি করছেন, তাতে কয়েক লাখ টাকা দিয়ে সহায়তা করছেন এই দু’জনই।

জীবনগল্পের ইতি টানতে গিয়ে বলেন, নেশাখোর স্বামী ছেড়ে চলে গেছেন বহু আগে। দুই ছেলেকে গোয়ালন্দবাজারে বাড়ি ভাড়া করে রেখেছি। বয়স হয়ে যাচ্ছে। শরীরও আর টানে না। চলে যাব এ পাড়া থেকে। গ্রামে বাড়ি করছি। অন্য কিছু করে বাকি জীবন পার করব। জাগো নিউজ