খাগড়াছড়ির মুনাফ ৩৫বছর পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরল

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে বিনা পাসপোর্টে দন্ডের কারাবাস শেষে ৩৫বছর পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে নিজ বাড়িতে ফিরেছেন জেলার মানিকছড়ি উপজেলার আবদুল মুনাফ। অবশেষে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পারিবারিক যোগাযোগ পুন:স্থাপন(আরএফএল) বিভাগ, সংগঠনটির খাগড়াছড়ি ব্রাঞ্চ ও মানিকছড়ি ইউনিটের সহযোগিতায় দীর্ঘ ৩৫বছর পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে বাড়িতে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছেন খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা ৩নং যোগ্যছলা ইউনিয়নের ফকির টিলা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মুনাফ(৭০)।

বুধবার(২৯ জুন) বিকেলে রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের সদস্যরা তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেন। দীর্ঘ ৩৫বছর পর নিজ দেশে ফিরে খুশিতে আত্মহারা আবদুল মুনাফ। আবদুল মুনাফ উর্দু ভাষার যাতাকলে এখনো বাংলা ভাষা ভুলে যাননি। এখনো কিছুটা রপ্ত রেখেছেন নিজ মানষের ভাষা। এলাকার টগবগে যুবক এখন বয়োঃবৃদ্ধ। দীর্ঘ ৩৫বছর পর মুনাফ ফিরে আসার খবরে তাকে একনজর দেখতে বাড়িতে ভীড় করছেন উৎসুক জনতা।

গত মঙ্গলবার(২৮শে জুন) সকালে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পারিবারিক যোগাযোগ পুন:স্থাপন(আরএফএল) বিভাগ ও সদর দপ্তরের সহযোগিতায় একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশে ফিরেন মো: আব্দুল মুনাফ(৭০)। পরে সকল কার্যক্রম শেষে গত ২৯শে জুন বুধবার বিকেলে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জুনিয়র সহকারী পরিচালক এসএম জাহিদুর রহমান ও আরএফএল বিভাগের খাগড়াছড়ি সদস্য আল আমিন, মানিকছড়ি ইউনিটের যুব প্রধান থোয়াই অংপ্রæুর মারমা ও আবু জাফরসহ একটি প্রতিনিধি দল তাকে(মুনাফ) পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন। দীর্ঘ ৩৫বছর পর বাড়ি ফিরে আসায় বয়োঃবৃদ্ধ স্ত্রী ও সংসারিক কন্যা ও ভাই বোনেরা আনন্দে আত্মহারা! এ সময় মুনাফের স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা আবেগাপ্লুত হওয়ায় কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেন।

তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তরকালে রেড ক্রিসেন্টের খাগড়াছড়ি জেলা আরএফএল টীমের সদস্য মোহাম্মদ আল আমিন, মানিকছড়ি উপজেলা যুব রেড ক্রিসেন্টের সাবেক যুব প্রধান মিন্টু মারমা, দলনেতা থোয়াইঅংপ্রæু মারমা, যুব সদস্য আবু জাফরসহ যুব রেড ক্রিসেন্ট সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
পরিবারে ফিরে এসে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে মো: আব্দুল মুনাফ বলেন, দীর্ঘ ৩৫বছর আমি পাকিস্তানে অবস্থান করি এবং সেখানে প্রায় ১৭বছর আমি বিভিন্ন কারণে কারাবরণ করি। কারাগারে থাকা অবস্থায় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহযোগিতায় আমি মুক্ত হয়ে দেশে ফিরতে পেরেছি। আমার স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে কাছে পেয়েছি। আমি সংগঠনের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আবদুল মুনাফ আরো বলেন, ‘আমার পরিবারের অভাব দূর করতে বিনা পাসপোর্টে আমি পাকিস্তান গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে যাই। বাংলাদেশকে খুব মিস করতাম। আমি নামাজ পরে আল্লাহর কাছে দোয়া করে আমার নিজ দেশে যেতে চাইতাম। আমি সকাল-সন্ধ্যা সর্বদা আমার জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পায়চারী করতাম। বাংলাদেশে ফিরে যেতে আমি অনেক কান্নাও করেছি, অনেকের সাহায্য চেয়েছি। সব শেষে ৩৫বছর পর আমি আমার প্রাণের দেশ বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছি। আজ আমি অনেক খুশি। যাদের কারণে আমি দেশে ফিরে আসতে পেরেছি, তাদের ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না।

আবদুল মুনাফের স্ত্রী খোদেজা খাতুন বলেন, ‘আমি সব সময় আমার স্বামীর জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। আমি আশায় থাকতাম যে আমার স্বামী ফিরে আসবে। এভাবে দিন যেতো, রাত যেতো কিন্তু আমার স্বামী ফিরে আসতো না। আমার অনেক কান্না আসতো। আল্লাহর কাছে সবসময় আমার স্বামীকে ফিরে পেতে দোয়া করতাম। ৩৫বছর পরে আমার স্বামীকে ফিরে পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা। আজ যেন আমার বাড়িতে ক্ষন ঈদ।’
বড় ভাই আব্দুল জব্বার সর্দার জানান, ‘আমার ভাইকে ফিরে পেয়ে আমার শূন্য বুকটা ভরে গেছে। আমাদের খুশির কথা মুখে বলে বুঝাতে পারব না। আমার ছোট ভাই আবদুল মোনাফ জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে পাসপোর্ট ছাড়াই পাকিস্তান চলে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে তিনি পাকিস্তান পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। অনেককে দিয়ে অনেক খবর নিয়েছি, চেষ্টা তদবির করেছি কিন্তু ভাইকে কোনভাবে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারছিলাম না। এ অবস্থায় দীর্ঘ ৩৫বছর পর বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের মাধ্যমে আমরা আমার ভাইকে ফেরত আনতে পেরেছি। আমরা জাতীয় এবং খাগড়াছড়ি রেড ক্রিসেন্টের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’

প্রায় ৩ যুগ আগে আমাদের পরিবারে আয় রোজগার কম ছিল। ফলে পরিবারের আয়ের কথা রেখে একদিন আমার ভাই মুনাফ ভারতে যান। এর পর নিরুদ্দেশ! ভাইকে ফিরে পেতে অনেক চেষ্টা, খোঁজ খবর নিয়েও খোঁজ পাইনি। ফলে আমরা ভাইয়ের, স্ত্রী তাঁর স্বামী এবং পুত্র-কন্যা তাঁদের বাবার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্ব মানবিক সংগঠক রেড ক্রিসেন্টের পারিবারিক যোগাযোগ পুন:স্থাপন বিভাগের কারাবন্দি অনুসন্ধানে পাকিস্তানের একটি কারাগারে খোঁজ মেলে আমার ভাই আব্দুল মুনাফের! পরে সংগঠনটির সদর দপ্তর, পাকিস্তান রেড ক্রিসেন্ট ও ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্যা রেড ক্রস(আইসিআরসি)’র সহযোগিতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আমাদের কাছে হস্তান্তর করেন। আমরা ভাইকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। রেড ক্রিসেন্টের সকল সদস্যের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ।

খাগড়াছড়ি জেলা রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের ভাইস-চেয়ারম্যান এডভোকেট জসিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং পাকিস্তান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহযোগিতায় এটি সম্ভব হয়েছে। সারা বিশ্বব্যাপী যে সব লোক নিখোঁজ হয় এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাদেরকে রিস্টোরি ফ্যামিলি লিং এর মাধ্যমে রেড ক্রিসেন্ট তাদের পরিবার পরিজনদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ ৩৫বছর পর আবদুল মুনাফকে তার পরিবারের মাঝে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কাজগুলো আমরা বরাবরই করে থাকি ভবিষ্যতে তা অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আরএফএল বিভাগের জুনিয়র সহকারী পরিচালক এসএম জাহিদুর রহমান জানান, মো: আব্দুল মুনাফকে বিমানযোগে পাকিস্তান থেকে প্রথমে তুরস্ক এয়ারলাইন্স হয়ে বাংলাদেশে আনা হয়। তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।

খাগড়াছড়ি জেলা রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের কার্যনির্বাহী সদস্য মো: দুলাল হোসেন বলেন, ‘এটি একটি মানবিক কাজ। রেডক্রিসেন্ট ইউনিটের দুই দেশের তৎপরতায় এটি সম্ভব হয়েছে।’ এই জাতীয় কোন তথ্য কারও কাছে থাকলে খাগড়াছড়ি রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটকে জানাতে আহবান জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘ইউনিটের এ·পার্ট টিম ট্রেসিং এর কাজ করে যদি যথাযথ হয় তাহলে জাতীয় সদর দপ্তরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ সারা পৃথিবীতে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট মানবিক ও আইনি সহতায় নিয়ে কাজ করছে। এই জাতীয় কাজটি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি নিজ ঘরে ফিরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সংস্থার নিজ খরচে করে থাকে। পাকিস্তান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বিমান ভাড়া দিয়ে আবদুল মোনাফকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে আর বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জাতীয় সদর দপ্তরের লোকজন তাকে বাড়িতে পৌছে দিয়েছে।

উল্লেখ্য খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার যোগ্যাছোলার ফকির টিলার মো: করিম ৩৫বছরের টগবগে যুবক মুনাফ। পিতা-মাতা, ৪ বোন, ৬ ভাইয়ের একক পরিবারের অভাবী সংসার। স্ত্রী, ১ ছেলে, ১মেয়েকে রেখে ১৯৮৭সালে চোরাই পথে কর্মের সন্ধানে পাড়ি জমান প্রতিবেশি দেশ ভারতে। সেখানে স্থায়ী কর্ম না পেয়ে এক বছর পর আদমবেপারীর খপ্পরে পড়ে পাড়ি জমান পাকিস্তানের করাচি শহরে। না সেখানেও ভাগ্য তাকে সুপথ দেখায়নি! কিছুদিন যেতে না যেতে অবৈধ অনুপ্রবেশ আইনে তাকে জেলে যেতে হয়েছে কয়েকবার। দেশে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন উন্নত না থাকায় জীবনের বিভীষিকাময় কাহিনী বা ঘটনাগুলো পরিবারে জানানো সুযোগও ছিল না মুনাফের! এভাবে এক বার জেল, এক বার বাইরে থেকে জীবনের ৩৫টি বছর কেটে গেছে অকাতরে৷ নিঃসঙ্গতায়!