খাগড়াছড়িতে ব্যাঙ বিক্রির অপরাধে ৩জনের কারাদন্ড

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা শহরের বাজারে ব্যাঙ বিক্রির অপরাধে ৩জনকে ৬মাস করে কারাদন্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমান আদালত।

বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) খাগড়াছড়ি বড় হাটের দিন দুপুরে সহকারি বন সংরক্ষক মো: মোজাম্মেল হোসেনকে সাথে নিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ নওশাদ হাসান। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের ১২/৩৪(ক) ধারায়-খাগড়াছড়ি পৌর এলাকার বাসিন্দা রুবেল দাস, মোহাম্মদ হৃদয় ও আইয়ুব আলী এই ৩জনের প্রত্যেককে ৬মাস করে কারাদন্ড প্রদান করা হয়।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ নওশাদ হাসান বলেন, পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এমন যে কোন কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়িতে ব্যাঙের আরত রয়েছে। প্রতি বৃহস্পতিবার জেলা শহর বড় বাজারে ১৫-২০টি ব্যাঙ বিক্রির দোকান বসে এবং প্রতি হাটবারে ৭০০-১০০০ কেজি পর্যন্ত ব্যাঙ খাগড়াছড়ি বাজারে বিক্রয় হয়। জেলার অন্যান্য বাজারেও কম বেশি ব্যাঙ বিক্রি হয়। জীবিত ব্যাঙের প্রতিকেজি বর্তমানে ১৮০টাকা। মৃত ব্যাঙ ১৩০-১৫০টাকা। কখনো এর দাম উঠে ৩০০-৩৫০টাকা কেজি। দীর্ঘদিন যাবৎ অসাধু ব্যবসায়ীরা পার্বত্য এলাকায় অবাধে অবৈধ এ ব্যাঙের ব্যবসা করে আসলেও এটি বন্ধে তেমন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। গত বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ নওশাদ হাসানকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার এ নির্দেশ প্রদান করেন।

উল্লেখ্য যে, প্রাণী কুলের মধ্যে ব্যাঙ অত্যন্ত একটি উপকারি প্রাণী।এছাড়াও একটি ব্যাঙ উভচর প্রাণী যার অপর নাম ভেক। জাত ভেদে ব্যাঙের খাদ্যের ভিন্নতা থাকলেও বেশিরভাগ ব্যাঙই পোকামাকড় ধরে খায়। এ কারণেই হয়তোবা ব্যাঙকে বলা হয় ‘পোকা মারার প্রাকৃতিক যন্ত্র’। ব্যাঙ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে এবং মানুষের অনেক উপকারে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেভ দ্য ফ্রগের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ও ইকোলোজিস্ট ড. কেরি ক্রিগার এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশের ধানভিত্তিক কৃষির জন্য ব্যাঙ অপরিহার্য। তার মতে, ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ব্যাঙের ভূমিকা অন্যতম। ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদে ফার্টিলাইজার ও পেস্টিসাইডের ব্যবহার মানুষসহ প্রাণীর স্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’
আরো জানা গেছে, ব্যাঙ প্রাকৃতিকভাবে ডেঙ্গু, গোদ রোগ, কলেরা, টাইফয়েড, এনথ্রা·, ম্যালেরিয়ার মতো অনেক ভয়ংকর রোগবাহী কীটপতঙ্গ খেয়ে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে মানুষকে রক্ষা করে। একটি ব্যাঙ প্রতিদিন তার দেহের অর্ধেক পরিমাণ পোকা খেতে পারে। এ কারণে পরিবেশ রক্ষায় ব্যাঙ সংরক্ষণের দাবি জোরাল হয়ে উঠেছে। আবার ব্যাঙ
ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় খেয়ে ফসল সুরক্ষা এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এজন্য ব্যাঙকে ‘প্রাকৃতিক কীটনাশক’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

হতাশার খবর হচ্ছে যে, কীটনাশকের অতি ব্যবহার এবং বন-জঙ্গল উজাড়সহ বিভিন্ন কারণে জীববৈচিত্র্য রক্ষাকারী ব্যাঙের সংখ্যা এখন তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। প্রতিনিয়তই নষ্ট হচ্ছে ব্যাঙের বাসস্থান ও প্রজনন-আশ্রয়স্থল। কৃষি জমিতে ব্যাঙের মলমূত্র ও দেহাবশেষ পচে মাটির উর্বরতা শক্তি এবং ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শস্যতের ঘাসফড়িং, সবুজ পাতাফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, পামরি পোকা ও হলুদ মাজরা পোকা খেয়ে উপকার করে। ফলে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। মশা ও ছোট ছোট ক্ষতিকর জীব খেয়ে মানুষের উপকার করে ব্যাঙ।

উভচর প্রাণী ব্যাঙ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। জল ও স্থল উভয় ক্ষেত্রে এদের অবাধ বিচরণ। বিভিন্ন গবেষণা তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত হারিয়ে যাওয়া প্রাণী হচ্ছে ব্যাঙ। গবেষণা তথ্য অনুযায়ী ১৯৮০সালের পর পৃথিবী থেকে ২০০প্রজাতির ব্যাঙ হারিয়ে গেছে। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের(আইইউসিএন) ২০১৫সালের রেড লিস্ট বা লাল তালিকা অনুসারে, বাংলাদেশে ৪৯প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্ন। বিপন্ন ব্যাঙের মধ্যে দুই প্রজাতি মহাবিপন্ন, তিন প্রজাতি বিপন্ন ও পাঁচ প্রজাতি সংকটাপন্ন অবস্থায়। ২৭প্রজাতি কিছুটা উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। ৬ প্রজাতি বিপন্ন অবস্থায নেই। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, পানিদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের অসচেতনতা প্রধানত এই চার কারণে ব্যাঙ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।