চতুর্দশ নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন মালয়েশিয়ানরা

এগারো দিনের তীব্র প্রচার শেষে মালয়েশিয়ানরা বুধবার চতুর্দশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন। প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং ভালো কিছু আসছে বলে ভোটারদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

এবার দেশটির দেড় কোটি যোগ্য ভোটারের আগামী পাঁচ বছরের জন্য সপ্তম প্রধানমন্ত্রী বেছে নেয়ার পালা। মালয়েশিয়ার ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। এতে প্রায় দুই হাজার ৩৩৩ প্রার্থী অংশ নিয়েছেন।

এবারের নির্বাচনে এক নবতিপর বৃদ্ধ তার সাবেক অনুগতকে হারাতে অবসর ভেঙে মাঠে নেমেছেন। ৯২ বছর বয়সী ড. মাহাথির মোহাম্মদ যদি নির্বাচিত হন, তবে তিনিই হবেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক সরকারপ্রধান।

যদি এটি কোনো সিনেমার গল্প হতো, তবে এমন কাহিনী ভাবতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হতো। কিন্তু এটি মালয়েশিয়ার নির্বাচন বলে কথা। কাজেই কী ঘটবে, তা আগভাগে বলা মুশকিল।

এবারের নির্বাচনে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দুটো বিষয়ই ইস্যু হিসেবে সক্রিয়। মাহাথির মোহাম্মদ এক সময়ের অনুগত নাজিব রাজাককে প্রধানমন্ত্রী হতে নিজেই সাহায্য করেছিলেন।

এখন অবশ্য বলছেন, এটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এখন তিনি সেই ভুল সংশোধন করতে চাচ্ছেন।

২০১৫ সালে রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে মাহাথির তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এমনকি নাজিবের পতন ঘটাতে তিনি আবার রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

নাজিব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি নির্বাচিত হলে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির দিকে যাবে।

মালয়েশিয়ার চলতি নির্বাচনের ফল কী হবে, তা ভোটার, বিশ্লেষক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের চিন্তার জগতকে এলোমেলো করে দিয়েছে।

বারিশন নাসিওনাল জোটের প্রধান হাজি মোহাম্মদ নাজিবের বাবা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মালয়ী রাজনৈতিক অভিজাতদের একজন আবদুল রাজাক হোসেন। আবদুল রাজাক সত্তরের দশকে প্রায় ছয় বছর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন নাজিব। মাহাথির মোহাম্মদ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে তার রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার লড়াই।

চলতি নির্বাচনে তিনি সহজেই জয়ী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে তার জোয়ারে ভাটার টান পড়েছে।

অসদুপায় অবলম্বন ও নির্বাচনে আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকলেও তিনি এবার অনেক কম ভোট পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অরগানাইজেশনের (উমনো) ভেতর থেকেই তার বিরুদ্ধে আপত্তি উঠতে শুরু করেছে।

এবার যদি উমনো ১৩০ আসনের কম পায়, তবে নির্বাচনের পর দলে তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দলে ইতিমধ্যে তাকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।

নাজিব রাজাকের সমালোচনা করা ও বিরোধীদের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ায় গত সপ্তাহে উমনো তার দুই জ্যেষ্ঠ নেতাকে বহিষ্কার করেছে। তারা দুজনই মাহাথিরের দীর্ঘদিনের অনুগত ছিলেন।

১৯৫৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মালয়েশিয়া শাসন করছে বারিশন নাসিওনাল জোট। মাহাথির মোহাম্মদও এই জোটের হয়ে ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ তহবিল ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ (১এমডিবি) থেকে নিজের ব্যাংক হিসেবে অর্থ সরিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন নাজিব। তার বিরুদ্ধে সাড়ে চারশ কোটি ডলার তহবিল চুরির অভিযোগ তোলেন দেশটির কর্মকর্তারা।

তবে প্রধানমন্ত্রী নাজিব এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি ভুল কিছু করেননি। এ অর্থ সৌদি রাজপরিবার দান করেছে।

নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় টিকে গেলেও এ কেলেঙ্কারিতে তার রাজনৈতিক হিসেবে নিকেষ বদলে যেতে পারে। এতে তার রাজনৈতিক লড়াইয়ের পরিসর ছোট হয়ে এসেছে।

জন ক্যাবোট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয়েশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্রিজেট ওয়েলশ বলেন, আমি মনে করি দেশটিতে পরিবর্তনের হাওয়ায় নতুন গতিবেগ পেয়েছে। নাজিব খুব জোরালোভাবেই নির্বাচনের দিকে হেঁটেছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটি তার হেরে যাওয়ার নির্বাচন। প্রচার অভিযানে তিনি নতুন কোনো ভাষ্য দিতে পারেননি। কাজেই অনেক কিছুই তার থেকে দূরে সরে যাবে।

গত দুই নির্বাচনে বিরোধীরা স্থিতিশীলভাবে উন্নতি ধরে রেখেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টে বারিশন নাসিওনাল জোটের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে তারা ভাঙন ধরিয়েছিল ও পরের নির্বাচনে জনপ্রিয়তায়ও এগিয়ে যায় বিরোধীরা।

এবারে নাজিবের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন তার গুরু ও সাবেক দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি তার পুরনো দল থেকে সরে এসে নতুন একটি দল গঠন করে বিরোধীদের সঙ্গে জোট বাধেন।

এমনকি মাহাথিরের সাবেক উত্তরসূরি ও উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীমসহ যাদের একসময় তিনি জেলে পুরেছিলেন, তাদের নিয়েই এ জোট।

প্রবীণ মাহাথির পাকাতার হারাপান বা প্রত্যাশার জোটের প্রধান হয়ে রাজনীতিতে ফিরেছেন। সমকামিতার অভিযোগে আনোয়ার ইব্রাহীম কারাবন্দি হওয়ার পর বিরোধীরা হালে তেমন পানি পাচ্ছিলেন না। তিনি সেই জোটে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলেন।

আনোয়ার ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই অধিকাংশ মানুষের ধারণা।

স্বয়ং মাহাথিরও যখন তাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করেছিলেন, তখনও তাকে একই অভিযোগে জেলে ঢুকিয়েছিলেন। যে কারণে কর্তৃত্বপরায়ণ ও রাজনৈতিক বিভেদ তৈরির বদনাম মাহাথিরের বিরুদ্ধে আছে।

নির্বাচনের প্রচারে মাহাথিরের জনসমাবেশগুলো ছিল লোকে লোকারণ্য। এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ যখন বক্তৃতা দিতে মঞ্চে ওঠেন, হাজার হাজার জনতাকে তখন হাততালি দিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা গেছে।

রোববার কুয়ালালামপুরের এক জনসভায় তাকে বলতে দেখা গেছে, সরকারকে পরাজিত করার এখনই সময়। কারণ আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ।

সমাবেশকে তিনি প্রশ্ন করেন, কেন আমরা তাদের হারাতে চাই? কারণ তারা চোরদের সরকার। তিনি যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন হাজার দশেক জনতা বজ্রকণ্ঠে চিৎকার দিয়ে তাকে সমর্থন জানিয়েছেন।

অনেকের মত হচ্ছে, বিরোধী জোটে একমাত্র মাহাথিরের দলই মালয়দের অধিকার নিয়ে সোচ্চার রয়েছে। দেশটির সবচেয়ে বড় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হচ্ছে এই মালয়রা।

গ্রামীণ আসনগুলোকেই দীর্ঘদিন ধরে সরকারি দলের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। নাজিবের অর্থ কেলেঙ্কারি পাড়াগাঁওয়ের ভোটারদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলেনি বলেই ধরে নেয়া যায়।

বিশেষ করে সাবাহ ও সারওয়াকের মতো গ্রামীণ অঞ্চলের কৃষক ও নৃতাত্ত্বিক মালয়দের মধ্যে রাজাকের সমর্থক সংখ্যা বেশি।

সোমবার এক বিবৃতিতে নাজিব রাজাক বলেন, কেবল স্বার্থপরের মতো ক্ষমতা দখল করতেই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তাদের কান্না কিংবা হাস্যকর অভিযোগে আপনারা বোকা হয়ে যাবেন না।

এর পরও গ্রামীণ মানুষদের মনে বড় ধরনের ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। আর ক্ষোভ না বাড়ার কোনো কারণ নেই। কারণ দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। মানুষের জীবনযাত্রার খরচ ঊর্ধ্বমুখী।

গাড়ি চালিয়ে কুয়ালালামপুর থেকে দুই ঘণ্টার পথ সাবাক বারনামের এক মৎস্যজীবী বলেন, কেবল বেঁচে থাকার জন্য আমরা অতিরিক্ত সময় কাজ করছি। না হলে আমাদের জীবন অচল হয়ে যাবে।

বছর তিনেক আগে পণ্য ও সেবা করারোপ করায় সবকিছুর মূল্য সার্বিকভাবে বেড়ে গেছে। বিরোধীরা অবশ্য জীবনযাত্রার মূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাদের ইশতেহারে।

কিন্তু অপর এক ভোটার বলেন, সরকার আমাদের জন্য এ পর্যন্ত যা করেছে, তাতে আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করছি।

বারিশন নাসিওনাল উদারভাবে ভোটারদের দিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচনের সময় সরকারি কর্মকর্তা ও নিম্ন আয়ের মানুষদের মুঠোভর্তি অর্থ বিতরণ করেছে তারা।

নির্বাচনে জিতলে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

মারডেকা সেন্টারের গত সপ্তাহের এক জরিপে দেখা গেছে, জনপ্রিয়তায় বিরোধীদের কিছু উন্নতি হলেও পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য তা যথেষ্ট না।

সরকারবিরোধী রাজনীতিবিদদের অভিযোগ, সবকিছু এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে নির্বাচন তাদের প্রতিকূলে যায়। নির্বাচনের আসনের সীমানা এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে, যাতে তা ক্ষমতাসীন জোটের অনুকূলে থাকে।

বিরোধী জোটের অধিকাংশ ভোটার শহরের। কিন্তু এসব আসন অনেক বড়। সেই তুলনায় গ্রামীণ আসনগুলো খুব ছোট।

আবার সরকারি দলের অধিকাংশ সমর্থক গ্রামের। এতে একেকটি আসনে জিততে সরকারি দলের চেয়ে বিরোধীদের অনেক বেশি ভোট পেতে হবে।

এভাবে আসনগুলোর সীমানা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন তা সরকারি দলের পক্ষে যায়।

পেনাং ইনস্টিটিউটের রাজনীতি বিশ্লেষক ওয়াং চিন হাউত বলেন, ১৬.৫ শতাংশ ভোট পেলেই সরকারি দল জিতে যাবে। কারণ দেশটির সবচেয়ে ছোট ১১২ আসনে ৩৩ শতাংশ ভোটার বাস করেন।

এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন বুধবারকে ভোটগ্রহণের দিন হিসেবে ধার্য করেছে। এতে দিনটিতে ছুটি না থাকায় ভোটারের অংশগ্রহণ কম হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

মালয়েশিয়ার এ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। জয়ের জন্য দেদারছে ভোট কেনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। ভোট কেনাবেঁচার প্রবণতা দেশটিতে এর আগে কখনও এতটা দেখা যায়নি।

মালয়েশিয়ার হিউম্যান রাইটস কমিশন দাবি করেছে, নির্বাচনের পর্যবেক্ষণের আবেদন করেও তারা অনুমতি পায়নি।

এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া ও কিরগিজিস্তানসহ এমন সব দেশ থেকে পর্যবেক্ষক নেয়া হয়েছে, যাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বারিশন ন্যাশনালের স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনসের উপপ্রধান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, পক্ষদুষ্টতার অভিযোগ সবসময়ই বিরোধীদের এজেন্ডায় ছিল। এর মাধ্যমে তারা ভোটারদের সহানুভূতি পেতে চাচ্ছেন। নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতেই এটিকে কারণ হিসেবে হাজির করছেন তারা।

ভোটের লড়াই তিন দিক দিয়ে হওয়ায় সরকারি দল সেখান থেকেও সুবিধা পাবেন।

কট্টরপন্থী প্যান মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টি (পাস) এতদিন বিরোধী জোটের অংশ ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে সম্পর্কোচ্ছেদ ঘটেছে। ভোটের হিসাবে দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা অল্প কয়েকটি আসন পাবেন। এতে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াতে পারে মূল ধারার কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তখন ক্ষমতায় কারা যাবে তা নির্ধারণ করে দেবে এই পাস এবং দলটি ক্ষমতার শরিক হিসেবে আবির্ভূত হবে।

পার্লামেন্টের ২২২ আসনের মধ্যে এবার ১৫৪টিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে দলটি। মাঠের লড়াই এটিই তাদের সর্বোচ্চ সংখ্যা।

এসব কিছু হিসেবে নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন বারিশন ন্যাশনাল জোটকে হটানো সম্ভব হবে না।

রাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপ বলছে, বিরোধী জোটের জয়ের সম্ভাবনা কেবল ১৫ শতাংশ।