চার সেতুর ভাগ্য ঝুলে আছে চীনের হাতে

জাতীয় নির্বাচনের বাকি আর মাত্র কয়েক মাস। এ সময়ের মধ্যে অর্থাৎ বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদে চারটি বড় সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেতুগুলো হচ্ছে : পিরোজপুরে কঁচা নদীর ওপর ৮ম বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সেতু, পটুয়াখালীতে বগা নদীর ওপর ৯ম বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সেতু, বাগেরহাটে মোংলা নদীর ওপর ঝুলন্ত ১০ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু এবং খুলনায় ঝপঝপিয়া নদীর ওপর ১১তম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু।

এ সেতুগুলোর নির্মাণ শুরু না হওয়ার কারণ কী? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সেতু তৈরি হবে চীনের অনুদানে। এ কারণে প্রক্রিয়া শেষ করতেই চলে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়। দুই বছর আগে এসব সেতু নির্মাণে দেশটির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমে ঢিমেতালের কারণে এতদিনেও এগুলো নির্মাণ পর্যায়ে যায়নি।

এ অবস্থায় সেতুগুলোর বাস্তবায়ন দ্রুত করতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের চীনা কর্তৃপক্ষ এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রকল্পের এপ্রিল পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় এ তাগিদ দেয়া হয়। সভার কার্যবিবরণী সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরাও এ নিয়ে জোরালো যোগাযোগের তাগিদ দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম রোববার বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত হওয়ায় আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ৮ম বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সেতুটির প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। কেননা এটির অগ্রগতি একটি পর্যায় পর্যন্ত না এলে চীন বাকি সেতুগুলোর বিষয়ে কোনো কথা বলবে না। এ কারণে অ্যাপ্রোচ সড়কের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় আগেই স্থানীয় জনগণকে বুঝিয়ে অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ শুরু করা হয়েছে। যদিও বর্তমানে নিয়ম অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি মূল সেতুর নির্মাণ কাজ যত দ্রুত শুরু করা যায়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, যেহেতু সেতুগুলো চীনের অর্থায়নেই হচ্ছে সেহেতু তারা যখন যেভাবে করতে চায় সেভাবেই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের তেমন কিছু বলার নেই। তবে যদি দ্রুত এগুলোর বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে জনগণ যেমন তাড়াতাড়ি সুফল ভোগ করতে পারবে, তেমনি জাতীয় উন্নয়নও ত্বরান্বিত হতো। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিরও দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হতো। এ প্রেক্ষাপটে চীনের সঙ্গে নেগোশিয়েশন করা দরকার যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা সেতুগুলোয় অর্থায়ন করে।

সূত্র জানায়, ১৪ মে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রকল্পের এপ্রিল পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি সভা। ২৩ মে জারি করা ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে- রাজাপুর-নৈকাঠি-বেকুটিয়া-পিরোজপুর সড়কে বেকুটিয়ায় কঁচা নদীর ওপর ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সেতুর কাজ শুরুর জন্য ভূমি উন্নয়ন করে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নির্বাচন করে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় সভায় কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড নির্মাণ কাজ দ্রুত করার তাগিদ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে ভূমি অধিগ্রহণ দ্রুত সম্পন্ন করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ ত্বরান্বিত করতে একটি সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়।

পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার বগা নদীর ওপর ৯ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটির বিষয়ে সভায় জানানো হয়, এ সেতুটি নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালের ১১ মে চীনের সঙ্গে অনুদান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর মাসে ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং থেকে ডিটেইল ডিজাইন এবং কম্পোনেন্টভিত্তিক ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং স্টিমেট প্রণয়নের জন্য চীনা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশস্থ চীনা দূতাবাসের ইকোনমিক অ্যান্ড কর্মাশিয়ালের পক্ষ থেকে জানানো হয় ৮ম বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণের পর পর্যায়ক্রমে ৯ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এ অবস্থায় চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ডিটেইল ডিজাইন এবং অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করতে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার তাগিদ দেয়া হয়েছে।

মোংলা নদীর ওপর ঝুলন্ত ১০ম বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটির বিষয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও চীন সরকারের সঙ্গে ২০১৬ সালের ১৯ জুন তারিখে স্বাক্ষরিত এমওএম (মিউনিটস অব মিটিং) অনুযায়ী ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ৯ম, ১০ম, ও ১১তম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু বাস্তবায়নের জন্য ওই বছরের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ও চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ১০ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুটি নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট ইআরডি থেকে একটি চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চীনা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় ইআরডির সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

বটিয়াঘাটা-দাকোপ মহাসড়কে ঝপঝপিয়া নদীর ওপর ১১তম বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু (ঝপঝপিয়া সেতু) নির্মাণ প্রকল্পটির বিষয়ে সভায় জানানো হয়, এ সেতুটি নির্মাণে ২০১৬ সালের ১৯ জুন এমওএম এবং ১৪ অক্টোবর এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে চীনের অনুদান প্রাপ্তির জন্য ইআরডির সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার তাগিদ দেয়া হয়েছে সভায়।

এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চীনের দায়িত্বপ্রাপ্ত এশিয়া উইংয়ের প্রধান মো. জাহিদুল হক বলেন, এই সেতুগুলোর বিষয়ে ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখনই সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল। তারপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, চীন প্রত্যেক প্রকল্পের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির আওতায় অর্থায়ন করে। যখন চুক্তি হয় তখনই উল্লেখ থাকে কোন ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় অর্থায়ন করবে। সে ক্ষেত্রে হয়তো একটি সেতুর পরই আর একটি সেতুতে অর্থায়ন করতে পারে। তবে সেতুর নাম নির্দিষ্ট করা থাকে আগে থেকেই।