চ্যাম্পিয়ন সাফজয়ী খাগড়াছড়ির আনাই ও আনুচিংয়ে বয়সের ব্যবধান দুই মাত্র মিনিট
খাগড়াছড়ি ও রাংগামাটি পার্বত্য জেলার চ্যাম্পিয়ন সাফজয়ী পাহাড়ের ৫জন মধ্যে আনাই ও আনুচিং এর দুইজনে বয়সের ব্যবধান দুই মিনিট।
হিমালয় পরাজয় করে সাফ শিরোপা চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অন্যতম খেলোয়ার আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনী দুই যমজ বোন। দুই জনের বয়সের ব্যবধান মাত্র দুই মিনিট। চেহারায় মিল থাকলেও দুই জনের পছন্দের অমিল রয়েছে। তাদের জীবনের গল্পটা বেশ বেদনাদায়ক আবার রোমাঞ্চকরও। আনাই ও আনুচিং-এর জন্মের পর রিপ্রু ও আপ্রুমা মগিনি দম্পতি দুই কন্যা সন্তানকে আপদ মনে করলেও এখন দুই বোনই এখন পরিবারটির ভবিষ্যত আশার প্রদীপ। আনাই-আনুচিং এর আয়ে সুখে-শান্তিতে চলছে রিপ্রু মারমা ও আপ্রুমা মগিনীর সংসার।
দিনটি ছিল ২০০৩সালের ১লা মার্চ, রোজ রবিবার। প্রথমে আনাই মগিনি পৃথিবীতে আসে। তার মাত্র দুই মিনিট পর আনুচিং মগিনীর আগমন। এক সঙ্গে দুই মেয়ে জন্ম নেওয়ায় অনেকটা হতাশ হন রিপ্রু মারমা ও আপ্রুমা মগিনি। অভাবের সংসারে আগে এই দম্পত্তির ঘরে এসেছে তিন পুত্র ও দুই সন্তান। তাই উৎসবের পরিবর্তে দুশ্চিন্তা ভর করেছিল। অথচ সময়ের ব্যবধানে আজ সেই দুশ্চিন্তা উৎস আর খুশির ধ্বনি।
কৃষক রিপ্রু মারমার ঘরে আগেই ছিল তিন ছেলে ও দুই কন্যা সন্তান। দিনে এক বেলা খাবার উঠলে আরেক বেলা নিয়ে চিন্তা। এমন সময় স্ত্রী আবারও অন্তসত্তা কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই। ঘর আলো করে ঠিকই এলো এক ফুটফুটে শিশু। তাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত। এরই মধ্যেই দুই মিনিটের ব্যবধানে আরেক নবজাতকের আগমন। কোথায় আর উৎসব হবে। উল্টো দুশ্চিসবতার পাহাড় যেন মাথার উপর। কারণ দুই জনই কন্যা সন্তান! তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে এমনিতেই রিপ্রু ও আপ্রুমা মগিনি দম্পতির ৭জনের বড় পরিবার হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে যোগ হলো আরও দুটি নতুন মুখ।
সেই দুই যমজ শিশুই আজকের জাতীয় নারী দলের দুই ফুটবলার আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনি। এবার নেপালকে পরাজিত করার পিছনে দুই যমজ বোনেরই অন্যতম ভূমিকা ছিল। সবারই জেনে রাখা দরকার, সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে পরাশক্তি ভারতকে ১-০গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। আর সেই খেলায় একমাত্র গোলটি করেছিলেন খাগড়াছড়ির আনাই মগিনী। এছাড়া ২০১১সাল থেকে প্রতিটি জাড়ীয় পর্যায়ে টুর্নামেন্টে আনাই ও আনুচিং-এর বিশাল ভূমিকা ছিল।
সময়ের ব্যবধানে রিপ্রু মারমা ও আপ্রুমা মগিনির তিন ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার হয়ে গেছেন। বড় দুই মেয়েও বিয়ে করে স্বামীর পরিবারে। আর জন্মের পর যাদের আপদ ভেবেছিল বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণের ভারটা সেই আনাই ও আনুচিং। আনাই-আনুচিং এখন বাবা রিপ্রু মারমা ও আপ্রুমা মগিনির গর্ব। আনাই-আনুচিং-এর খেলা থাকলেই তাদের ছবি ভেসে ওঠে টিভির পর্দায়। পত্রিকার পাতায় বড় বড় ছবি ছাপা হয়। গ্রামবাসীকে সে ছবি দেখান। হয়তো আনমনে বলে ওঠেন, যাঁদের আবির্ভাবে একদিন চোখে আঁধার দেখেছি আজ তাঁরাই আমাদের ভবিষ্যত আশার-আলো।
অথচ এমনও জনশ্রæতি আছে, পরিবারের অভাব অনটন থাকায় ঠিক মতো তাদের দেখভাল করতে না পারার ভয়ে জন্মের পরপরই আনাই ও অনুচিং মগিনীকে হতদরিদ্র পিতা রিপ্রু মারমা দত্তক দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। বিষয়টি নজড়ে আসে রাঙামাটির মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমার। তিনি আনাই, আনুচিং মগিনীকে পরিবারসহ মঘাছড়ি নিয়ে যান। সেখানে তাদের থাকার বাড়ি করে দেন। আনাই-আনুচিং তখন ৩য় শ্রেনিতে পড়তেন। বীরসেন চাকমা তাদের নিজ স্কুলে ভর্তি করে দেন। ঋতুপর্ণা ও রুপনাও ছিলেন একই স্কুলের শিক্ষার্থী। এভাবে তিনি তার বিদ্যালয়ে পুরো একটি ফুটবল টিম গড়ে তুলেন। বীরসেন চাকমা বর্তমানে কাউখালী উপজেলার উল্টা পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
আনাই ও আনুচিং-এর দম ফেলার সময় নেই। প্রায় সারা বছরই থাকতে হয় ঢাকায়। একটির পর একটি টুর্নামেন্ট। এই দেশে সেই দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ এই দেশ তো কাল অন্য দেশে। তারা যমজ বোন হলেও তাদের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় অমিল রয়েছে। যেমন আনাই শান্ত প্রকৃতির। আর আনুচিং দুষ্ট প্রকৃতির। আনাই মায়ের ভক্ত আর আনুচিং বাবা ভক্ত। আনাই-এর পছন্দ মেসি আর আনুচিং-এর পছন্দ নেইমার। আনাই ডিফেন্ডার আর আনুচিং ফরোয়ার্ড।
সর্বশেষ সাফজয়ী খাগড়াছড়ির তিন নারী খেলোয়ার আনাই, আনুচিং, মনিকা ও সহকারী কোচ তৃষ্ণা চাকমার জন্য খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস ৪ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। এর আগে গত বছর জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস তাদের প্রত্যেকের বাসায় যান, গিয়ে তাদের বাড়ির যে সব সমস্যা ছিল তা প্রত্যাশা করেছে। সরকারি অর্থায়নে জেলা প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি মনিকা চাকমার বাড়িতে সরকারিভাবে ঘর নির্মাণ, বিদ্যুতায়ন, আনাই-আনুচিংদের বাড়িতে গভীর নলকূপ স্থাপন ও বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। প্রত্যেক ফুটবলারকে দুই লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র করে দিয়েছেন। তাদের জন্য আরো যদি করণীয় থাকে তা করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পাহাড়ে নারীরা ফুটবলে আরো অবদান রাখতে পারবে।
জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, এটা আমাদের গর্বের। তারা আমাদের মুখ উজ্জল করেছে, আমাদের আনন্দে ভাসিয়েছে। বিশ্বের বুকে তারা আমাদের পতাকা উড়িয়েছে। ‘সমাজের বিভিন্ন বিত্তবান মানুষ আছে, বিত্তবান এজেন্সি আছে। কিভাবে আমাদের নারী ফুটবলকে আরও এগিয়ে নেয়া যায়, তারা সবাই এ বিষয়টা নিয়ে ভাববেন। তাদের জন্য কিভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। আজকে তারা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কিন্তু যে সম্ভাবনা তারা দেখিয়েছে, সঠিক পরিচর্যা করলে এ মেয়েরা এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও শিরোপা জিততে পারবে।’
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস অরো বলেন, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পাহাড়ে নারীরা ফুটবলে আরও অবদান রাখতে পারবে বলেও এসময় জানান তিনি। খাগড়াছড়ি ফুটবল খেলে ইতিহাস গড়লো বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। ১৯ বছরের খরা কাটিয়ে এবার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তুলেছে অপরাজিতা চ্যাম্পিয়ন বাঘিনীরা। বাংলোদেশের মেয়েরা নেপালের মাটিতে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে নিজেদের ঘরে তুলেন। ‘বাংলাদেশের এ জয়ের বড় অংশীদার খাগড়াছড়ির ফুটবলাররা। তাদের এ অর্জনে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন ফুটবলার ও এক কোচের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে মোট চার লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তুলেছে অপরাজিতা চ্যাম্পিয়ন বাঘিনীরা।
গত সোমবার(১৯শে সেপ্টেম্বর) কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মতো শিরোপার জয় পায় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। ফাইনালে নেপালের কাঠমান্ডুতে স্বাগতিকদের ৩-১গোলে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। এমন দুর্দান্ত জয়ে গোটা দেশে আনন্দ উল্লাস। দেশের ফুটবলের অনন্য এই জাগরণ দেখলো সবাই। ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন