নারীরা ঘরে বসে কুরআন মুখস্থ করবেন যেভাবে

দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কিতাব ‘আল-কুরআনুল কারিম’। তা সিনায় সংরক্ষণ করতে পারা মহান রবের একান্ত অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি মুখস্থ করে হৃদয়ে ধারণ করতে পারাও অনেক মর্যাদা ও সম্মানের। তিনিই তাঁর এ কিতাবকে মানুষের হৃদয়ে ধারণ করার তাওফিক দেন।

কিন্তু পুরুষদের জন্য এ কুরআন মুখস্থের ব্যাপক সুযোগ থাকলেও নারীদের জন্য তা সহজ নয়। তাহলে নারীরা কীভাবে এ কুরআনুল কারিম মুখস্থ করার আকাঙ্ক্ষা মেটাবে?

মুমিন মুসলমান মাত্রই এটিকে হৃদয়ে ধারণ করার সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পুরুষদের তুলনায় নারীদের কুরআন মুখস্থের সে সুযোগ অনেক কম। কেননা চাইলেই পুরুষ ছেলেরা দূর-দূরান্তে গিয়ে কিংবা আবাসিক থেকে তা মুখস্থ করার সুযোগ পায়। কিন্তু নারীদের জন্য তা একটু কষ্টকর এবং বিপদজনক।

‘হ্যাঁ’, ইচ্ছে থাকলে নারীরাও সফলভাবে নিরাপদে পবিত্র কুরআনুল কারিম মুখস্থ করতে পারেন। নারীরাও পারেন তাদের হৃদয়ে কুরআনুল কারিমকে স্থান করে দিতে। এ অনুপ্রেরণা আর চেতনার কারণেই অনেক নারী পবিত্র কুরআনুল কারিমের হিফজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হন।

আবার অনেকেই ব্যক্তিগত অলসতা, পারিবারিক অসহযোগিতা কিংবা সামাজিক বৈষম্যের কারণে মাঝপথে ব্যর্থ হন। অথচ পরিবারের একটু সহযোগিতা ও উৎসাহ পেলেই পুরুষদের তুলনায় নারীরাই কুরআনুল কারিম মুখস্থে বেশি সফল হওয়া সম্ভব।

কিছু কৌশল ও সিদ্ধান্ত নিলেই নারীরা সহজে কুরআনুল কারিম মুখস্থ করতে সক্ষম হবেন। এর জন্য প্রথম নিজের চেষ্টা ও পারিবারিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। নারীদের কুরআন মুখস্থ করতে যে বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া জরুরি। তাহলো-

> মানসিক প্রস্তুতি

কখনোই এমনটি না ভাবা যে, পুরো কুরআনুল কারিম মুখস্থ করার এমন একটি কঠিন কাজ কি বাস্তবেই আমার দ্বারা সম্ভব? বরং এমনটি না ভেবে, মানসিকভাবে পবিত্র কুরআন সহিহ করে দ্রুত পড়ার নিয়তে কুরআনে শেখা শুরু করা। আর মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি নিয়মিত কুরআন পড়ার জন্য তৈরি থাকা।

> অল্প করে শুরু করা

কাজ যত বড়ই হোক না কেন, তার গণনা ০ এবং ১ থেকেই শুরু হয়। আর তাতেই মিলে সফলতা। ঠিক কুরআনুল কারিম মুখস্থ করার শুরুতে প্রথমেই আরবি বর্ণমালা আলিফ, বা, তা, ছা কিংবা আলিম, মীম, ত্বা, জ্বা- একটি একটি করে হরফ শেখার মাধ্যমেই শুরু করার বিকল্প নেই।

যখনই একটি, দুইটি করে সবগুলো হরফ সুন্দরভাবে শেখা হয়ে যাবে; তখন মনে হবে যেন বিশাল নির্মানের গাঁথুনি শুরু করার অপেক্ষায়। তারপর একটি শব্দ, বাক্য, আয়াত ধরে অল্প অল্প করে আস্তে আস্তে কুরআন শেখার বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখা।

> দেখে পড়ার প্রতি গুরুত্ব দেয়া

কুরআনুল কারিম পড়তে পারলেই মুখস্থ করার জন্য তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। বরং দেখে দেখে সুন্দরভাবে সাবলিল পঠনভঙ্গিতে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করা। পুরো কুরআন শরীফ দেখে দেখে এমনভাবে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করা যে, পড়ার সময় কুরআনের পৃষ্ঠা থেকে চোখ সরে গেলেও যেন পড়া বন্ধ হয়ে না যায়। কেননা যার নাজেরা যত সুন্দর ও সাবলিল হবে তার কুরআন মুখস্থ তত সহজ হবে।

> সময় নির্ধারণ করা ও পড়ার নিয়ম

কুরআন আত্মস্থ করার জন্য নিয়মিত নির্ধারিত সময় কুরআন পড়ার বিকল্প নেই। যেসব নারী স্কুল কলেজে পড়াশোনা করে কিংবা বাসা-বাড়িতে অথবা যে কোনো কাজে নিয়োজিত থাকে; সবার জন্য নির্ধারিত সময়ে কুরআন পড়ার বিষয়টি সুনির্দিষ্ট থাকা খুবই জরুরি।

তবে যেহেতু অধিকাংশ নারী ঘরেই বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করে; সুতরাং তাদের জন্য এ নিয়মটি খুবই কার্যকরী। তারা দিন ও রাতকে ৫টি অংশে ভাগ করে নিয়মিত কুরআন পড়ার সময় বের করা। তাহলো- ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব ও ইশা।

কুরআনুল কারিমের পড়া চালু ও সাবলিল করতে নিয়মিত এ পাঁচ সময়ে নির্ধারিত সময় পড়া খুবিই জরুরি। যেমন তা হতে পারে এমন-

– ফজরের নামাজের পর নির্ধারিত পরিমাণ আয়াত বা পৃষ্ঠা একাধিকবার পাঠ করা। ফজরের পর সুযোগ না হলে ফজরের নামাজের আগেই তা পড়ে নেয়া।

– জোহরের নামাজের পর সকালের একই পড়া রিভিশন তথা আবার এক বার পড়ে নেয়া।

– আসরের নামাজের পর তা আবারও একবার রিভিশণ দেয়া।

– মাগরিবেরনামাজের পর একবার দেখে দেখে পড়া।

– ইশার নামাজের পর কিংবা ঘুমানোর আগে এক বা একাধিকবার এ পড়াটিই পড়ে নেয়া।

এভাবে নিয়মিত নির্ধারিত পরিমান পড়া দিনের পাঁচ সময়ে ভাগ করে এক বা একাধিক বার পড়ার মাধ্যমে তা সুন্দর ও সাবলিলভাবে দেখে দেখে পড়ার অভ্যাস গঠন করা।

সপ্তাহে ৫ দিন এভাবে নির্ধারিত পরিমাণ আয়াত বা পৃষ্ঠা পড়ার পর দুই দিন নতুন সবক না পড়ে পেছনের পাঁচ দিনের পড়া রিভিশন দেয়া। তবে প্রতিদিন ফজরের সময় নতুন পড়ার শুরু আগে পেছনের পড়া একবার পড়ে নেয়া জরুরি।

> ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা

সফলতার জন্য ধারাবাহিকতা ঠিক রাখার বিকল্প নেই। বরং সফলতা পাওয়ার প্রথম শর্তই হলো চেষ্টা অব্যাহত রাখা তথা কুরআনুল কারিম পড়ার ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা। যেখানেই নামাজ পড়ার সুযোগ আছে, সেখানেই কুরআনুল কারিম পড়ার সুযোগও রয়েছে। সুতরাং নামাজ যেহেতু (সমস্যা ব্যতিত) কোনো অবস্থাতেই ছাড়া যাবে না; ঠিক একইভাবে কুরআন তেলাওয়াতও কোনোভাবে ছাড়া যাবে না। এমনটি যেন না হয়, একদিন বা এক বেলা বেশি সময় পড়ে পরের দিন বা পরের বেলায় আর না পড়া। এতে সফলতা পাওয়াও অসম্ভব।

> রিভিশন নিয়মিত রাখা

রিভিশিন বা পেছনের পড়া দুইভাবে পড়া। প্রতিদিন এবং সাপ্তাহিক। নতুন পড়া শুরু করার আগে অবশ্যই আগের দিনের পড়া একবার পড়ে নেয়া। তারপর সপ্তাহিক এক বা দুইদিন শুধু পেছনের পড়া রিভিশনের সুযোগ রাখা জরুরি। কেননা কুরআনুল কারিমের মুখস্থ অংশ ধরে রাখার অন্যতম মাধ্যম এ রিভিশন পদ্ধতি। এ কারণেই হাফেজে কুরআনগণ নিয়মিত ধারাবাহিকভাবে ১/২ পাড়া পড়ে থাকেন।

– রিভিশন না পড়ার ক্ষতি

সামনের দিকে পড়া চালিয়ে যাওয়ার সময় পেছনের পড়া ধারাবাহিকভাবে চালু না রাখলে পেছনের সব পড়া আবার হৃদয় থেকে মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সে কারণেই প্রতিদিন নতুন পড়ার আগে পুরোনো পড়া এবং সপ্তাহে পেছনের সব পড়া রিভিশন দেয়ার বিকল্প নেই। যদি কেউ পেছনের পড়া না পড়ে তবে তার অবস্থা হবে এমন যে, ফুটো (ছিদ্র) পাত্রে পানি রাখার মতো।

> একজন শিক্ষকের অধীনে থাকা

কুরআনের এ শিক্ষার্থীকে অবশ্যই একজন শিক্ষকের অধীনে থাকা আবাশ্যক। চাই সে শিক্ষক নারী বা (মাহরাম) পুরুষ হোক। যেন প্রতিদিনের পড়াই সে শোনে। আর তাতে পড়ার ধারাবাহিকতা ও নিয়ম রক্ষা হয়। ভুল হলে তা সংশোধনের সুযোগও তৈরি হয়। পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। কেননা শিক্ষার্থীর পড়া সুন্দর হলে অবশ্যই শিক্ষকের দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি তাকে পড়া চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ যোগাবেন।

> তুলনা না করা

কুরআনুল কারিম শেখা বা মুখস্থ করার সময় কেউ কাউকে অন্যের সঙ্গে তুলনা না করাই শ্রেয়। আবার পড়া কম-বেশি আদায় হলে অন্যের তুলনা না করাও উত্তম। এতে কুরআন শেখা বাধাগ্রস্ত হয়। বরং যখন যেটুকু পড়া আদায় হয় তার ওপর রাজি এবং খুশি থাকাই উত্তম ও কল্যাণের। এ জন্য হতাশ হওয়া যাবে না।

> আগ্রহ তীব্র রাখা

কুরআন শেখা বা মুখস্থ করার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি লালন করা। একদিন দুইদিন করে ধারাবাহিক কুরআন শেখা বা এক শব্দ/বাক্য/আয়াত মুখস্থ অব্যাহত রাখা এবং পরবর্তী শব্দ/বাক্য/আয়াত মুখস্থ করার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি হৃদয়ে জাগ্রত রাখা। আর তা যেন হয় মহান রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।

শুধু নারীরাই নয়, যেসব পুরুষ এখনো কুরআন পড়তে পারে না বা মুখস্থ নেই। এ নিয়ম মেনে কুরআন সুন্দরভাবে পড়ার বা মুখস্থ করার চেষ্টা করলে সহজেই তা মুখস্থ কিংবা সুন্দরভাবে পড়া সম্ভব।

> যখন মুখস্থ করা শুরু করবেন

নাজেরা বা দেখে দেখে সুন্দর ও সাবলিলভাবে পড়তে পারলে যখন কেউ দেখবে যে, সে কুরআন পড়ার সময় পৃষ্ঠা থেকে চোখ সরে গেলেও তার পড়া থেমে যাচ্ছে না বরং পড়া চালিয়ে যেতে পারছে; তখনই কেবল ওই নারী/পুরুষ নিয়ম করে কুরআনুল কারিম মুখস্থ করা শুরু করবে। আর সে সময় অবশ্যই একজন শিক্ষক কিংবা অভিভাবক প্রয়োজন হবে; যে নিয়মিত তার সবক বা পড়া ধরবে। অবসর সময় পেলেও নিরিবিলি মুখস্থ থাকা অংশ বেশি বেশি পড়া।

সর্বোপরি কুরআনুল কারিম মুখস্থ করার এ নেয়ামত অর্জন করতে মহান আল্লাহর কাছে বেশি সাহায্য চাওয়া। সব সময় কুরআন মুখস্থের বিষয়টি হৃদয়ে জাগ্রত রাখা। কখনো এমনটি না ভাবা যে- মনে হয় আমার দ্বারা কুরআন মুখস্থের কাজ হবে না।

চেষ্টা-সাধনা ও আগ্রহ থাকলে আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাব মুখস্থকারীর হৃদয়ে কুরআনকে সহজ করে গেঁথে দেবেন। এ নিয়ম মেনে চললে সব নারীর জন্যই সময়ে ব্যবধানে কুরআন মুখস্থ করা সম্ভব। ইনশাআল্লাহ।