নিন্দুকের মুখে কুলুপ এঁটে জীবন সংগ্রামে জয়ী সাতক্ষীরার কলারোয়ার এক নারীর গল্প…

সাতক্ষীরার কলারোয়ার দেয়াড়া ইউনিয়নের নারী মুক্তি সংসদের নেত্রী উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের মৃত শামছুদ্দীন সরদারের মেয়ে আকলিমা খাতুন। তিনি কৃষিতে অসমান্য অবদান রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরুষ্কার পেয়েছেন ২০১৬ সালে ও ২০২১ সালে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে এ পুরষ্কার তুলে দেন। এখানে শেষ নয় সেই নারী জাগারণে পথিকৃৎ আকলিমা খাতুন ২০১৬ ও ২০২১ সালে দুই বার ৪,৫,৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

তার এই কৃতিত্ব ও সাফল্যের গল্পের বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, আমার মতো এতো সুখী নয়তো কারো জীবন, প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষে কোরআন তেলাওয়াত, তারপর বৃদ্ধ মায়ের কাজে সহযোগিতা। ঘরের কাজ সেরে জনসমস্যা নিয়ে আসা মানুষের সাথে কথা বলা। এরপর নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়া। এলাকার মানুষের কৃষিবিষয়ক পরামর্শ দেয়া। সপ্তাহে চারদিন স্থানীয় নারীদের প্রশিক্ষণ। এছাড়া ইউপি সদস্য হিসেবে রেজিস্ট্রার অফিসের কাজকর্মের দেখাশোনা করা। পাশাপাশি মানুষের সুবিধা-অসুবিধাও দেখতে হয়।

অল্প বয়সে এমন কঠোর কাজগুলো কীভাবে করছেন জানতে চাইলে আকলিমা বলেন, প্রকৃতি আমাকে প্ররিশ্রমী হতে বাধ্য করেছে। এক সময় চাকরির আশায় টাকার কাছে হেরে গেছি। অবশেষে বেছে নেই এ কঠিন পথ। যে কঠিন পথ এখন জীবনটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে।গ্রাামের মেয়ে হওয়া সত্তেও আকলিমা উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন। ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়েন। পাশাপাশি রয়েছে শিক্ষক নিবন্ধন সনদপত্রও। এতকিছুর পরও মাটির দেয়াল আর টালি দিয়ে তৈরি ছোট্ট কুড়েঘরই আকলিমা ও তার মা সুফিয়া খাতুনের ঠিকানা।

তবে তিনি নিজেকে একজন সুখী ও অভাবহীন নারী বলেই তার অনুভুতি প্রকাশ করেন।

ঘরের থালা-বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে মাঠের কৃষিকাজ। এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধানেও অগ্রগামী আকলিমা। কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে এমন কিছু বাকি নেই যা আকলিমাকে করতে হয় না। যাতায়াতের জন্য কারো সহযোগিতা না নিয়ে নিজের স্কুটি চালিয়ে গন্তব্য পৌঁছানোর কাজটিও করতে হয় তাকে। সংসার জীবন থেকে শুরু করে কৃষিকাজ আবার জনপ্রতিনিধির কাজটি করছেন দুরান্তগতিতে। এই জন্য স্থানীয়ভাবে সংবর্ধনা পেয়েছেন কয়েকবার।

 

জীবনের বর্ণনা করতে গিয়ে আকলিমা আরো জানান, চার বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। অন্য তিন বোন বিবাহিত। ১৯৭৯ সালে জন্ম নেয়া আকলিমা স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় ১৯৯১ সালে চলে যান পার্শ্ববর্তী যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক পাসের পর ভর্তি হন রাজগঞ্জ কলেজে। ওই কলেজ থেকে ১৯৯৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মনিরামপুর কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। পরের বছর খুলনা সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকে (অনার্স) ভর্তির সুযোগ পান। মনিরামপুর কলেজ ছেড়ে ভর্তি হন বিএল কলেজে। বিএল কলেজে লেখাপড়া অবস্থায় ২০০০ সালে এলাকায় বন্যা হয়। খবর পেয়ে বাড়ি গিয়ে দেখেন এলাকার মানুষের কষ্টের শেষ নেই। আকলিমার বৃদ্ধ বাবা সামসুদ্দিন সরদার ছিলেন কৃষক। নিজেদের পৌনেপাঁচ বিঘা জমি চাষ করেই তাদের সংসার চলতো। কিন্তু ওই জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়।কপোতাক্ষের সংযোগে কোনো বাঁধ না থাকায় জমি বাঁওড়ের সঙ্গে মিশে যায়। তাদের মতো অবস্থা এলাকার অন্য সবার। উপায় না পেয়ে তারা সবাই যেন ত্রাণনির্ভর হয়ে পড়েন। ত্রাণ আছে তো খাবার আছে, ত্রাণ নেই তো খাবারের কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় আকলিমার বাবাও ত্রাণ নিয়ে সংসার চালান। এর মধ্যে আকলিমাও অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতে শুরু করেন। পাশাপাশি তার বাবাও দিনমজুরের কাজ করতেন। একদিন তার বাবা কৃষিকাজ শেষে বাসায় এসে বারান্দায় শুয়ে পড়েন। দেখে খুব কষ্ট হয় আকলিমার। সহ্য করতে না পেরে নিজেও কৃষিকাজ করে সংসার চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। একদিন খুলনা ফিরে কলেজ থেকে বই-খাতা, নোট সব নিয়ে বাড়ি আসেন আকলিমা। চেষ্টা করেন স্থানীয় স্কুলে চাকরি করার। কিন্তু একজন প্রভাবশালী নেতা চাকরির জন্য পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। এতো টাকা জোগাড় করার উপায় ছিল না আকলিমার। চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে যোগাযোগ করেন কৃষি অফিসে। যে জমি আছে তাতে কোনো ফসল উৎপাদন করা যায় কি না এমন পরামর্শ নেন কৃষি অফিস থেকে। গ্রহণ করেন সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে নিজেই বাঁওড় সংলগ্ন দুই বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলক ধান রোপণ করেন। জমির চাষ থেকে শুরু করে বীজ বপন, সার বোনা সব কাজ নিজেই করেন। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন তার বাবা।

একজন মেয়ের এমন কাজ দেখে এলাকার অন্য কৃষকরা বিভিন্ন মন্তব্য করেন। কিন্তু তাতে কান দেননি আকলিমা। প্রথম বছরই দুই বিঘা জমিতে ৩৮ মণ ধান পান আকলিমা। এরপরই নিন্দুকের মুখে কুলুপ এঁটে যায়। পাশাপাশি এলাকার অন্যান্য কৃষিজীবী মানুষ তার এ কাজে উদ্বুদ্ধ হন।