পবিত্র ঈদুল আজহার তাৎপর্য

মহান স্রষ্টার প্রতি সঠিক আনুগত্য ঘোষণা, তার সন্তুষ্টি ও মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করাই ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের শিক্ষা। এই আনন্দ ত্যাগের আনন্দ। কোরবানির আনন্দ উৎসর্গের আনন্দ। শুধু ভোগে নয়, ত্যাগের মধ্যেও আনন্দ ও সুখ আছে। কোরবানির দিনটি এ শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত সুখ আর আনন্দের উৎস সম্পদে নয়; ভোগে নয় বরং ত্যাগে।

মানুষের যা কিছু আছে তা অন্যের জন্য ত্যাগের মধ্যেই প্রকৃত সুখ। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আল্লাহর নবী হজরত ইব্রাহিম আ: ও তাঁর ছেলে হজরত ইসমাইল আ: কোরবানির নিমিত্তে অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন মানব ইতিহাসে। ঈদুল আজহার দিনই হজরত ইব্রাহিম আ:-এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান স্মারক। হজরত ইব্রাহিম আ: মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন মক্কার মরু প্রান্তরে। মহান আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম আ:-এর পরম আনুগত্য ও সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দেখে তার কোরবানি কবুল করে নেন এবং হজরত ইসমাইল আ:-এর স্থলে একটি দুম্বা কোরবানি মঞ্জুর করেন। হজরত ইব্রাহিম আ:-কে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কোরবানিসহ বিভিন্ন পরীক্ষা দিতে এবং কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রতিটি যুগের কালের চাহিদা অনুযায়ী মুসলিম জাতি তার আদর্শ সামনে রেখে এ জাতির শ্রেষ্ঠত্বের প্রয়োজনে কোরবানি দিয়ে আসছে। কোরবানির পশু জবাই আসলে একটা প্রতীকী ব্যাপার। কারণ আল্লাহ পাক নিজেই বলেছেন, পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত- কিছুই তার কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু খোদাভীতি তথা তাকওয়া ও পরহেজগারি।

ইতিহাসে জানা যায়, কোরবানি দেয়ার রীতি পৃথিবীর আদিকাল থেকেই চলে আসছে। আদি পিতা হজরত আদম আ:-এর সময়কালেও কোরবানির রেওয়াজ চালু ছিল। কোরবানি হজরত আদম আ:-এর সুন্নত ও আদর্শ। সে সময় কোরবানিকৃত গোশত-দ্রব্য পাহাড়ের চূড়ায় বা কোনো উঁচু স্থানে রেখে আসলে তা যদি আকাশ থেকে অগ্নিবর্ষিত হয়ে পুড়ে যেত, তাহলে কোরবানি আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছেন বলে গণ্য হতো। যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তার সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করার জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষণার উপলক্ষ্য এবং সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয় সারা বিশ্বে।

এ উৎসব আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধিসহ মানুষের অন্তর্নিহিত পশুত্ব কোরবানির উৎসব। ঈদুল আজহা ত্যাগের, আলøাহর আনুগত্যের, আত্মসমর্পণের এবং আত্মোপলব্ধির মহান স্মারক।

ঈদুল আজহাকে ঈদুল কবির, অর্থাৎ বড় ঈদ বলা হয়। কোরবান বা কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। এ শব্দটি কুবরের শব্দমূল থেকে উৎপন্ন। কুবরের অর্থ, নৈকট্য বা সান্নিধ্য। তাহলে ঈদুল আজহার অর্থ দাঁড়ায় কোরবানি। বা উৎসর্গ বা ত্যাগের পরম আনন্দ। কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের বড় মাধ্যম হিসেবে ত্যাগ স্বীকার করাই হলো কোরবানি।

প্রকৃত অর্থে, এটা হলো নিজেকে আমৃত্যু আল্লাহর রাস্তায় সমর্পণ করা। হজরত ইব্রাহিম আ:-এর নিজ ছেলে ইসমাইল আ:-কে কোরবানি করার ঐশী নির্দেশের পরীক্ষা থেকে বর্তমান পদ্ধতির কোরবানির সূচনা হয়েছে। ইসলামি শরিয়তে মুসলিম জাতির পুরো জীবনটাই একটি কোরবানিতুল্য। এ কোরবানি হতে পারে জান, মাল, সম্পদ, সময়, স্বার্থ, ইচ্ছা ও পশুত্বের। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ ও সম্পদত্যাগ করতে সর্বদাই প্রস্তুত থাকা চাই। ঈদুল আজহা মানে নিছক পশু কোরবানি নয়, বরং পরম ত্যাগ ও উৎসর্গের অঙ্গীকার। আল্লাহর পথে ইব্রাহিম আ:-এর অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপনের ফসলই হলো কোরবানি। কোরবানি শুধু একটি আনন্দ উৎসব নয়; এর সাথে জড়িত রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন। ঈদুল আজহা আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় উজ্জীবিত এক অনন্য সাধারণ উৎসব। কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে ইব্রাহিম আ: সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত এবং সর্বযুগের ও কালের মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন।

শুধু পশু নয়, প্রয়োজন পশুত্বের কোরবানি। প্রতিটি মানুষের ভেতর একটি ‘হিংস্র পশু’ আছে যেটা আমাদের প্রতিনিয়ত অন্যায় ও পাপ কাজে উসকানি প্রদান করে থাকে এবং আত্মাকে পাপিষ্ঠ আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন ও শত কালিমাময় আত্মা। মানুষের অন্তরাত্মা পাপে ও গোনাহে ভরা, যা সম্মিলিত নাম পশুত্ব। সর্বপ্রথম এ পশুত্বকেই কোরবানি করার পর পশু কোরবানি করা বিধেয়। কোরবানির প্রকৃত সার্থকতা কোরবানিদাতার কুপ্রবৃত্তিগুলো বিসর্জনের মধ্যে নিহিত। ইব্রাহিম আ:-এর কোরবানি ছিল তার ছেলের জীবন আর ইসমাইল আ:-এর কোরবানি ছিল তার নিজের জীবন। এটা মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কোরবানি। ইব্রাহিম আ:-এর পরিবার সারা মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ। মুসলিম উম্মাহকে এটা ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শ স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম উম্মাহর মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল কুরআন ও সুন্নাহ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে ইব্রাহিম আ:-এর আদর্শের বাস্তবরূপ। প্রত্যেক ক্ষেত্রে ইসলামি মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়ার মধ্যেই হজ ও কোরবানির সার্থকতা।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিজাতীয় অপসংস্কৃতি এবং চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ আমাদের নৈতিক, আদর্শিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর চরম আঘাত হেনেছে। ফলে মুসলিম পরিবারের সদস্যরা অনেকটা ঐতিহ্যচ্যুত। নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সর্বক্ষেত্রে পদদলিত। তাই হজরত ইব্রাহিম আ:, বিবি হাজেরা এবং হজরত ইসমাইল আ:-এর অনুসৃত আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত। ঈদুল আজহা মানুষের জীবনে নিয়ে আসে স্বতন্ত্র আদর্শের প্রতীক। মানুষের ত্যাগ, ভক্তি, বিশ্বাস ও আত্মনিবেদনের শক্তি কত অপ্রতিরোধ্য হতে পারে এ ঈদের আদর্শ তার প্রমাণ।

 

 

লেখক :
প্রফেসর মো. আবু নসর
সাবেক অধ্যক্ষ,
কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা