পরবর্তী আইজিপি কে হচ্ছেন, নাকি মেয়াদ বাড়তে পারে ড. বেনজীরের

বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদের চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর। আড়াই লাখের বেশি সদস্যের পুলিশ বাহিনীর নতুন নেতৃত্বে কে আসছেন? নাকি বর্তমান আইজিপির মেয়াদ বাড়ানো হবে- এ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন।

পরবর্তী পুলিশ প্রধান হিসেবে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম শোনা যাচ্ছে। তবে কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, বর্তমান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ আরও এক বছরের জন্য এই পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা থাকবে অগ্রগণ্য। এজন্য পরবর্তী আইজিপি হিসেবে যাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, এসব বিষয় ভেবেই তাকে দায়িত্ব দেবে সরকার।

৩১তম পুলিশ প্রধান পদের জন্য আগ্রহী অনেক কর্মকর্তা এরইমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছেন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চার বছর সময় ধরে আইজিপি ছিলেন হাসান মাহমুদ খন্দকার। ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

নতুন আইজিপি হিসেবে আলোচনায় যারা

র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন
বাংলাদেশ পুলিশের ৩১তম আইজিপি হিসেবে র‌্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাম সামনে আসছে। অষ্টম বিসিএস ব্যাচের এই কর্মকর্তার আগামী ১১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা। তবে সরকার চাইলে তাকে আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। সৎ পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে বাহিনী ও সরকারের কাছে তার সুনাম রয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশে অসামান্য অবদান ও অনন্য সেবাদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) ও প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) পদকে ভূষিত হয়েছেন। গত বছরের ১৮ অক্টোবর চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ১৯৬৪ সালের ১২ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার শ্রীহাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকসহ (সম্মান) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে ঢাকা রেঞ্জে ও ডিআইজি হিসেবে ডিআইজি (অপারেশনস্), ডিআইজি (প্রশাসন), রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে ময়মনসিংহ ও ঢাকা রেঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এরপর পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত আইজিপির (এইচআরএম) দায়িত্ব পান। র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে যোগদানের আগে তিনি সিআইডি প্রধান হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন।

এটিইউ প্রধান মো. কামরুল আহসান
আইপিজি হিসেবে আলোচনায় আছেন জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে গড়ে তোলা পুলিশের বিশেষায়িত শাখা অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. কামরুল আহসান। তিনি ১৯৬৬ সালে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ইমামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে (এমবিএ) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯১ সালে বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে যোগদান করেন। মৌলিক ও বাস্তব প্রশিক্ষণ শেষে খাগড়াছড়ি জেলার সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়িত হন। এরপর চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী সার্কেল এএসপি, এএসপি ডিএসবি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি, ফেনী জেলার অ্যাডিশনাল এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া শরীয়তপুর, চট্টগ্রাম ও যশোর জেলার পুলিশ সুপার, পুলিশ সদর দপ্তরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (সংস্থাপন) ও অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ট্রেনিং) এবং রেলওয়ে রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য পুলিশ কর্মকর্তা মো. কামরুল আহসান জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের ‘পুলিশ অ্যাডভাইজার’ হিসেবে সিয়েরালিওন ও সুদানে দায়িত্ব পালন করেন।

সুদান মিশনের কনটিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনের গৌরব অর্জন করেন তিনি। পাশাপাশি মিশনগুলোতে দৃষ্টান্তমূলক চাকরির স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পদক’ লাভ করেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের এস এম রুহুল আমিন
পরবর্তী আইপিজি হিসেবে আলোচনায় আছেন ১২তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (লজিস্টিকস অ্যান্ড অ্যাসেট অ্যাকুইজিশন) এস এম রুহুল আমিন। তিনি গোপালগঞ্জ সদর থানায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতকসহ (সম্মান) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

এস এম রুহুল আমিন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার, সিলেট জেলার পুলিশ সুপার, ঢাকায় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এবং রেলওয়ে পুলিশের ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) কমিশনার হিসেবে যোগদান করে বরিশালে পুলিশি সেবার নতুন দিগন্তের সূচনা করেন।

পুলিশের এই কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আইভরিকোস্ট ও দক্ষিণ সুদানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করেছেন।

হাইওয়ে পুলিশের প্রধান মল্লিক ফখরুল ইসলাম
আইপিজি হিসেবে আলোচনায় আছেন হাইওয়ে পুলিশের (অতিরিক্ত আইজিপি) প্রধান মল্লিক ফখরুল ইসলাম। ১৯৬৯ সালের ১৫ জানুয়ারি বাগেরহাট জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৯১ সালের ২০ জানুয়ারি ১২তম বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন মল্লিক ফখরুল ইসলাম।

২০০৩ সালে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে ভোলা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, ফেনী জেলার পুলিশ সুপার এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি কমান্ডার হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুনাম অর্জন করেন। এরপর অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০১২ সালে র‌্যাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০১৪ সালে ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে রেলওয়ে পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, সিটি এসবি ও ট্যুরিস্ট পুলিশে কর্মরত ছিলেন।

ড. বেনজীর আহমেদ
বর্তমান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ ১৯৬৩ সালের ১ অক্টোবর গোপালগঞ্জের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া প্যাসিফিক সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা চার্লস স্ট্রার্ট ইউনিভার্সিটি ও সিঙ্গাপুরে বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পড়াশোনা করেন ড. বেনজীর আহমেদ। ২০১৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

আইজিপি হিসেবে যোগদানের পর ড. বেনজীর আহমেদের হাত ধরে পুলিশে বেশকিছু সংস্কার এসেছে। যোগ হয়েছে নতুন নতুন বিষয়, আধুনিক হয়ে উঠেছে পুলিশ বাহিনী। তার নতুন নতুন উদ্যোগের কারণে পুলিশ বাহিনী এখন হয়ে উঠেছে জনবান্ধব। ‘বিট পুলিশিং’ কার্যক্রম চালু করেছেন তিনি। এতে থানায় না গিয়ে ঘরে বসে পুলিশের সেবা পাচ্ছে মানুষ, কমেছে ভোগান্তি। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও বেড়েছে।

২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার বেনজীর আহমেদকে দেশের ৩০তম পুলিশপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়। এরপর থেকে তার নানা পদক্ষেপের কারণে ‘জনমুখী পুলিশি সেবা’ পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। থানা থেকে বের করে পুলিশকে মানুষের দোরগোড়ায় নিতে একের পর এক সাহসী ও সময়োপযোগী নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, করোনাভাইরাসের মহামারি মোকাবিলায় মানুষের পাশে থেকে সেবা দেওয়া, জঙ্গি ও মাদক নির্মূলে প্রতিনিয়ত অভিযানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে পুলিশ।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর বেনজীর আহমেদকে র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি দায়িত্ব বুঝে নিয়ে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে ভূমিকা পালন করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান তিনি। হলি আর্টিসান হামলায় প্রাথমিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নির্মূলে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানও বেগবান রেখেছেন তিনি।

সুন্দরবনের জলদস্যুতার অবসান ঘটিয়ে একটি স্বস্তির উপকূলীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রেখেছেন ড. বেনজীর আহমেদ। এছাড়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান তার সাফল্যের মুকুটে আরও একটি উজ্জ্বল পালক।

বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম
এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সরকার যদি ড. বেনজীর আহমেদকে আগামী এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়, তাহলে পরবর্তী আইজিপি হিসেবে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।

তথ্যসূত্র: জাগোনিউজ