আন্তর্জাতিক সেমিনারে বক্তারা

পশ্চিমা হস্তক্ষেপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সত্যিকারের কূটনীতির স্থান নেই

বাংলাদেশে রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভিকেন্তিয়েভিচ মানতিৎস্কি বলেছেন, যেহেতু পশ্চিমা দেশগুলি ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে, এই মুহূর্তে সত্যিকারের কূটনীতির কোনও জায়গা নেই। সেদেশের কূটনীতিকরা জোরালোভাবে রাশিয়ার পরাজয়ের দাবি করছে এবং ইউক্রেনকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করার আহ্বান জানাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, “আমরা কখনই ইউক্রেনীয়দের সাথে কথা বলতে অস্বীকার করিনি, যা বেলারুশ এবং তুরস্কে অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই বৈঠকগুলি ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য, কিয়েভ থেকে একটি গঠনমূলক অবস্থানের প্রয়োজন যা বর্তমানে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেনীয় পৃষ্ঠপোষকরা কিয়েভকে মস্কোর সাথে কোনও গঠনমূলক আলোচনা করতে বাধা দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যা রাশিয়ার প্রচেষ্টাকে নিষ্ফল করে তোলে”। তিনি আরও বলেন, মস্কো সবসময় কূটনৈতিক আলোচনাকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। তারা বিশ্বাস করে যে এই কূটনৈতিক আলোচনার জন্য একাধিক পক্ষের প্রয়োজন যা এ মুহূর্তে অনুপস্থিত।

৭ জুন ২০২২-এ ‘বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কূটনীতির গুরুত্ব’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

এটি আয়োজন করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইন্সিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্স (এসআইপিজি)’র সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস)।

সেমিনারে উপস্থিত বক্তাদের মধ্যে ছিলেন, বাংলাদেশে রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভিকেন্তিয়েভিচ মানতিৎস্কি, বাংলাদেশে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা ওসমান তুরান, জার্মানির পিআরআইএফ’এর পরিচালক অধ্যাপক ড. নিকোল ডিটেলহফ, নরওয়ের আর্কটিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গুনহিল্ড হুগেনসেন জর্ভ, এবং বাংলাদেশ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বর্তমানে এসআইপিজির প্রফেসরিয়াল ফেলো রাষ্ট্রদূত শহীদুল হক। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন এনএসইউর উপ উপাচার্য অধ্যাপক এম. ইসমাইল হোসেন।

মুস্তফা ওসমান তুরান বলেন যে তুরস্ক সবসময় ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও তার অখণ্ডতাকে সমর্থন করে এবং রাশিয়ার আগ্রাসনকে জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করে। যুদ্ধরত উভয় পক্ষই বর্তমানে সামরিক লাভের দিকে মনোনিবেশ করছে, তবে যুদ্ধের সমাপ্তি এবং শান্তি স্থাপন শুধুমাত্র আলোচনার টেবিলেই হতে পারে। তিনি আরও বলেন যে আমরা একটি কূটনৈতিক সমাধানের আশা ছেড়ে দিতে পারি না। এবং যুদ্ধের অবসানে বহুপাক্ষিক প্রচেষ্টা ও আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির গুরুত্বের উপর তিনি জোর দেন। তিনি আরও বলেন যে, তুরস্ক ইউক্রেনে শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় যার ফলস্বরূপ ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চলগুলি সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার করা হবে। তিনি আরও দাবি করেন যে, ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে এবং একই সাথে রাশিয়ার সাথেও তাদের কার্যকর সম্পর্ক রয়েছে যা দুই দেশের মাঝে শান্তি স্থাপনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রফেসর ড. নিকোল ডেইটেলহফ বলেন যে উভয় পক্ষকে আলোচনার জন্য ছাড় দিতে হবে এবং এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা হচ্ছে এই যুদ্ধে তাদের ব্যয় বৃদ্ধি করা ও ভবিষ্যতে এরুপ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা এবং এই ধরনের বেআইনি আগ্রাসন প্রতিরোধ করা। এই যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করেছে, এবং উদ্বাস্তু সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। তিনি আরও বলেন, এটি শুধুমাত্র কোনো সামরিক অভিযান নয় বরং একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ যা পুরোপুরি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

অধ্যাপক গুনহিল্ড হুগেনসেন জিরভ বলেন যে রাশিয়া অবৈধভাবে ইউক্রেনকে আক্রমণ করেছে কিন্তু ইউক্রেন নিজেকে রক্ষা করছে এবং এই ধরনের পরিস্থিতিতে কূটনীতিক প্রক্রিয়া কঠিন। তিনি আরও বলেন যে, যুদ্ধের আগেই এই ইস্যুতে কূটনীতি শুরু হয়েছিল এবং ইউক্রেন গত আট বছর ধরেই এ বিষয়টি মোকাবেলা করছে। তিনি আরও বলেন যে, এ মুহূর্তে কোন পক্ষই আপস করতে ইচ্ছুক নয়, তাই কূটনীতির ক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির ভূমিকা কি হতে পারে তা একটি পর্যবেক্ষণের বিষয়।

রাষ্ট্রদূত শহীদুল হকের মতে, রাশিয়া এই যুদ্ধকে তাদের এবং পশ্চিমাদের মধ্যে একটি সংঘর্ষ হিসাবে দেখে – যা এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কূটনীতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার একটি বড় কারণ । তিনি আরও বলেন যে, এই যুদ্ধে কূটনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত দেশগুলি কেবল নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকবে ততক্ষণ কূটনীতির কোনও স্থান নেই। তিনি আরও যোগ করেন, কূটনীতিই শেষ ভরসা কারণ এই যুদ্ধের ময়দানে শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্জিত হবে না। তার মতে, এ যুদ্ধের ফলে সমরাস্ত্র ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে কারণ তারা বিভিন্ন ধরণের অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে এবং সব পক্ষের কাছে নতুন নতুন অস্ত্র বিক্রিও করছে।

সেমিনারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, কূটনীতিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিক, এবং শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।