প্রথমবারের মতো নেদারল্যান্ডের টিউলিপ ফুলের চাষ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়

দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড় এই এলাকায় প্রথমবারের মত সফল ভাবে শীত প্রধান দেশের নজরকারা ফুল টিউলিপ চাষ হচ্ছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। উপজেলার সদর ইউনিয়নের দর্জিপাড়া ও শারিয়াল জোত গ্রামে আরএমটিপি’র আওতায় দেশের প্রথমবারের মতো বৃহৎ পরিসরে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফ এর সহযোগিতায় উত্তরাঞ্চলের টিউলিপ চাষ সম্প্রসারণ উপ-প্রকল্প বিষয়ক টিউলিপ চাষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন ইকো-সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-ইএসডিও।

জানা যায়, টিউলিপ শীত প্রধান অঞ্চলের ফুল। এটি নেদারল্যান্ডস’র ফুল। যা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুত্বপূর্ণ ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ। এটি বাগানে কিংবা কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা হয়। ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখার জন্য এর আবেদন অনন্য। বর্ষজীবি ও কন্দযুক্ত প্রজাতির এ গাছটি লিলিয়াসিয়ে পরিবারভূক্ত উদ্ভিদ। টিউলিপের প্রায় ১৫০ প্রজাতি এবং এদের অসংখ্য সংকর রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের হাইব্রিডসহ টিউলিপের সকল প্রজাতিকেই সাধারণভাবে টিউলিপ নামে ডাকা হয়। টিউলিপ মূলত বর্ষজীবি ও শীত প্রধান দেশের বসন্ত ালীন ফুল হিসেবে পরিচিত। উচ্চমুল্যের এই ফুলের বাণিজ্যিক চাষের উদ্যেশে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলকভাবে ফার্ম আকারে চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন ইএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান ও পরিচালক (প্রশাসন) সেলিমা আখতার।

গত সোমবার সকালে শারিয়াল জোত ও দর্জিপাড়া গ্রামে টিউলিপ তিনটি শেড ঘুরে দেখা যায়, ৪০ শতক জমিতে ৮ জন চাষী পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করছেন নেদারল্যান্ডস’র টিউলিপ ফুল। বাগানগুলোতে ফুটতে শুরু করেছে ফুল ফোটা। তিনটি শেডের তিন সারিতে শতাধিকের বেশি টিউলিপ ফুটেছে। কয়েক দিন ধরেই একের পর এক ফুটতে শুরু করেছে এই ফুল। সাধারণত বেগুনি ও লাল রঙের ফুল ফুটতে দেখা গেছে।

ইএসডিও’র এভিসিএফ আসাদুর রহমান জানান, টিউলিপ চাষ শুরু করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে শারিয়াল ও দর্জিপাড়া গ্রামে ৮ নারী উদ্যোক্তা টিউলিপ চাষ করছেন। ডিসেম্বরে নেদারল্যান্ডস থেকে উচ্চ মূল্যে ৪০ হাজার বøাব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত) রোপন করা হয়। টিউলিপের ৬টি ভাইলের ১২কালারের টিউলিপ চাষ হচ্ছে। অ্যান্টার্কটিকা (সাদা), ডাচ সানরাইজ (হলুদ), স্ট্রং গোল্ড (হলুদ), বেগুনি প্রিন্স (বেগুনি), ডেনমার্ক (কমলা), রিপে (কমলা), অ্যাড রেম (কমলা), টাইমলেস (লাল সাদা শেড), ইলে দে ফ্রান্স (লাল), লালিবেলা (লাল), বার্সেলোনা (গাঢ় গোলাপী), মিল্কশেক (হালকা গোলাপী)। আর ইএসডিও’র এই প্রকল্পে ৮ জন নারী উদ্যোক্তা চাষ করছেন এই ফুল। এই উদ্যোক্তারা হচ্ছেন দর্জিপাড়ার মুক্তা পারভীন, আনোয়ারা বেগম, সুমি আক্তার ও শারিয়াল জোত গ্রামের আয়শা বেগম, হোসনে আরা বেগম, মনোয়ারা বেগম, মোর্শেদা বেগম ও সাজেদা বেগম।

উদ্যোক্তা মনোয়ারার স্বামী আতিয়ার রহমান ও মোর্শেদার স্বামী নুরুল হক জানান, আমরা চারজন মিলে ২০ শতক জমিতে নেদারল্যান্ডের শীতকালিন ফুল টিউলিপ লাগিয়েছি। যা ইএসডিও আমাদের সহযোগিতা ও উদ্বুদ্ধ করেছে। এ বøাব লাগানোর আগে আমরা জেনেছিলাম ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা থাকলে এ ফুল চাষ করা সম্ভব। এখন দেখছি রোপনের প্রায় মাস খানেকের মধ্যেই ফুল ধরতে শুরু করেছে। সীমান্তের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের মতো জায়গায় বিদেশী ফুল চাষ করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এ ফুল বাজারজাত করতে ইউএসডিও নিয়েছে, আশা করছি দাম পাব।

উদ্যোক্তা আয়শা আক্তার জানান, ইএসডিও’র সহযোগিতায় আমি ৫ শতক জমিতে টিউলিপ লাগিয়েছি। ৫ হাজার বøাব লাগানোর প্রায় এক মাসের মাথায় ফুল আসতে শুরু করেছে। এই অঞ্চলে বিদেশী ফুল চাষ হবে কল্পনাই করতে পারিনি। খুব অবিভূত হয়েছি। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এই ফুল দেখতে আসছে। এ ফুল বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয় হলে আগামীতে আরো জমিতে এ ফুল চাষ করবো।

সমাজসেবা কর্মকর্তা শাহ মো.আল আমিন জানান, তেঁতুলিয়ায় শীত প্রধান অঞ্চলের বিদেশী ফুল টিউলিপ চাষ হচ্ছে ভাবাই যায় না। খুব ভালো লাগছে। এ ফুল যেমন অর্থনীতি সম্ভাবনা ঘটাবে তেমনি পর্যটনে নতুনমাত্রা তৈরি করবে।

ইএসডিও’র সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর আইনুল ইসলাম জানান, দেশের উত্তরাঞ্চলের পর্যটনের শিল্পের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে ইএসডিও’র উদ্যোগে পিকেএসএফ সহযোগিতায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে টিউলিপ ফুল চাষ সম্প্রসারণের উপযোগিতা নির্ণয় শীর্ষক ভ্যালু চেইন পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রাথমিকভাবে আমরা প্রান্তিক ৮জন নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে পরীক্ষামূলক ৪০ শতক জমিতে টিউলিপ চাষ শুরু করেছি। টিউলিপের ৬ প্রজাতির ১২টি রং রয়েছে। যা এখন পারপল কালার তথা বেগুনী রংয়ের ফুল ধরেছে।

ইএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান জানান, বাংলাদেশে ফার্ম আকারে টিউলিপের চাষ এটাই প্রথম। বিদেশী ফুলটি দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দিতে দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়াকে বেঁছে নিয়েছি। আমরা পাঁচজন প্রান্তিক চাষীদের নিয়ে ৪০ হাজার বøাব লাগিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এ ফুলের চাষ শুরু করেছি। ফুলও আসতে শুরু করেছে। এ ফুলের চাষের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অন্যতম অঞ্চল এখন তেঁতুলিয়া। ইতিমধ্যে টিউলিপ ফুলের বাগান দেখতে বিভিন্ন পর্যটকের সমাগম ঘটতে শুরু করেছে। আশা করছি এ ফুলের চাষের মাধ্যমে চা শিল্পের মতো টিউলিপ চাষের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। অর্থনীতি, শৈল্পিক ও পর্যটনে নতুনমাত্রা তৈরি করতেই আমাদের এই উদ্যোগ। এছাড়াও ইকো ট্যুরিজম গড়তে বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলে জানান তিনি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ দেশে এখনো ‘টিউলিপ ফুলের চাষ সেভাবে শুরু হয়নি। ফুল প্রেমিরা হয়তো শখের বশে বাড়িতে টবে চাষ করতে পারেন। কিন্তু এরকম বড় পরিসরে টিউলিপ চাষ উত্তরবঙ্গের তেঁতুলিয়ায় প্রথম। এ ফুল চাষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ। ফুলটি চাষ করতে হলে তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে উত্তরের এ উপজেলায় হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা নিকটস্থ হওয়ার কারণে কয়েকমাস সর্বনিন্ম তাপমাত্রা থাকে এ অঞ্চলে। শীত অঞ্চল হিসেবে টিউলিপ চাষে বাড়তি সুবিধা রয়েছে। টিউলিপের বাণিজ্যিক চাষ করা যেতে পারে। তবে এদেশে ফুল ফুটলেও পরবর্তীকালে রোপণের জন্য টিউলিপগাছের বাল্ব সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বাল্ব সংরক্ষণ করতে হয়। তাই এটা টিউলিপ চাষের বড় সীমাবদ্ধতা। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস তা গুরুত্বের সাথে নিয়ে সব ধরণের সেবা দিচ্ছে। আশা করছি পরীক্ষামূলকভাবে এ চাষ সাফল্যের মুখ দেখবে এবং পর্যটন শিল্পের ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।