প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে প্রাধান্য পাবে অর্থনৈতিক চুক্তি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্থগিত জাপান সফর আগামী এপ্রিলে হতে পারে। এই সফরে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কমর্কর্তারা জানিয়েছেন, সফরে জাপান সরকারের সঙ্গে বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ (বিগ বি) বাস্তবায়ন, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বা অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির (ইপিএ) বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে।

তিন দিনের দ্বিপক্ষীয় সফরে গত বছরের ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান যাওয়ার কথা থাকলেও পরে তা স্থগিত করা হয়। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে প্রধানমন্ত্রীর সফর স্থগিত করা হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করতে জাপানের সহকারী মন্ত্রী দুই দিনের সফরে অক্টোবরে বাংলাদেশেও আসেন।

পরে গত মাসের (১১ জানুয়ারি) গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতকালে ঢাকায় নবনিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি তার দেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে জাপান সফরের প্রস্তাব দেন। সৌজন্য সাক্ষাতের পরে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জাপানি রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আগামী মার্চ-এপ্রিলে জাপান সফরের প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এপ্রিলে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

এই সফরে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সম্পর্ক আরো অন্যন্য উচ্চতায় মাত্রা পাবে বলে অনেকেই মনে করছেন। জাপান বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী উল্লেখ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, জাপানের সবধরনের অথনৈতিক সহযোগিতা আমাদের কাম্য। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে—এ জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটি (বিএইচটিপিএ), বাংলাদেশের জাপান দূতাবাস, ইউএনআইডিও, টোকিওর আইটিপিওর অংশগ্রহণে একটি ওয়েবিনার আয়োজন করা হয়। সেখানে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে এমন প্রায় ৭১ দশমিক ৬ শতাংশ জাপানি কোম্পানি তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহ জানিয়েছে। ১০০টির বেশি জাপানি কোম্পানি ওয়েবিনারে অংশ নেয়। ওয়েবিনারে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হাই-টেক পার্কগুলোতে বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা হয়।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য বৈঠককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সফর করছে জাপান সরকারের আট সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জাপানি বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন অসুবিধা দূর করতে একটি কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। এই কমিটি বিভিন্ন সময় জাপানি বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে বিভিন্ন সুপারিশ করে থাকে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, জাপানের প্রতিনিধি দল তাদের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ সুবিধা, ইকোনমিক জোনে জাপানের বিনিয়োগের সুবিধা-অসুবিধা নিয়েও আলোচনা করতে পারে। ইতিমধ্যেই নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জাপানি বিনিয়োগকারীরা ১৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, জাপানের কাছে বাংলাদেশ খুবই আকর্ষণীয়। এ কারণে ২০১৪ সাল থেকে জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের পরামর্শে বিগ বি উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কেন্দ্র এবং পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিগ বি উদ্যোগ বাংলাদেশ ছাড়াও এই অঞ্চলের একাধিক রাষ্ট্রে বাস্তবায়নাধীন। ইন্দো-প্যাসিফিকের মূল ধারণা জাপানের বিগ বি উদ্যোগ থেকেই নেওয়া।

পররাষ্ট্র কর্মকর্তারা আরও জানান, বঙ্গোপসাগরের তীরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম ঘিরে বিগ বি উদ্যোগকে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও নতুন বিনিয়োগ সুযোগ তৈরির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে ধরা হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়ে দিয়েছে, বিগ বির আওতায় সবধরনের অর্থ ও বাণিজ্য সম্পর্কে রাজি আছে বাংলাদেশ। কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক ইনিশিয়েটিভে অস্ত্র সহযোগিতার মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের খবর, ২০২১-২২ অর্থবছরে জাপানে এক হাজার ৩৫৪ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে দেশটি থেকে আমদানি করা হয়েছে এক হাজার ৪১০ কোটি ডলারের পণ্য।

এদিকে (১৫ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে নবনিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি

বলেন, ২০২৩ সালে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫১তম বার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই বন্ধুদেশ হিসেবে জাপান বাংলাদেশের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্ভাব্য সবধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

ইওয়ামা কিমিনোরি বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় ও স্থানীয় উন্নয়নে জাপান বন্ধুদেশ হিসেবে আরও সম্পৃক্ত হতে চায় যাতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। এ সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও জাপানের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে জাপানের সহায়তায় চলমান বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেন। তারা উভয়ে উন্নয়নমূলক কাজে এই সম্পৃক্ততা আরও জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।