বাড়তি ভাড়া আর সীমিত আসনের যাঁতাকলে সাধারণ মানুষ

বাড়তি ভাড়া আর সীমিত আসনের যাঁতাকলে পড়েছে সাধারণ মানুষ। অফিস-আদালত, জনজীবন সবই স্বাভাবিক কিন্তু সংকটেও গণপরিহবনে আসন সীমিত করায় করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে আরেক দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

মূলত করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে লাগাম দিতেই গণপরিবহনে যাত্রী সংখ্যা সীমিত করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর গতকাল বুধবার রাজধানীর মালিবাগ, শান্তিনগর, কাকরাইল, পল্টন, প্রেসক্লাব ও তোপখানা রোডের মোড়ে যাত্রীদের একরকম যুদ্ধ করে বাসে ওঠার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। রাজধানীর বেশির ভাগ রুটেই বেসরকারি যেসব মিনিবাসগুলো চলাচল করে, সেগুলো কমবেশি ৫০ আসনের। সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পর অর্ধেক আসন খালি রেখেই ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে সেগুলো যাত্রী পরিবহন করছে এখন। কিন্তু অফিস-আদালত সব খোলা থাকায় গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বাসে উঠতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে যাত্রীদের। কোনো বাস স্টপেজে এলেই অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যাচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে এসব দৃশ্য দেখা গেছে গতকাল।

এর আগে করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সরকার ১৮টি জরুরি নির্দেশনা জারি করে। এর মধ্যে গণপরিবহনে ৫০ শতাংশ সিট ফাঁকা রাখার কথা বলা হয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী দুই সপ্তাহের জন্য গণপরিবহনের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়। যা গতকাল বুধবার সকাল থেকে কার্যকর হয়েছে। তবে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়ার জায়গায় শতভাগ ভাড়া আদায় নিয়েও বাসে বাসে বাগ্বিতণ্ডায় জড়াতে দেখা গেছে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের।

গতকাল সকালে মালিবাগ থেকে বিমানবন্দর যাওয়ার জন্য তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন বেসরকারি চাকরিজীবী শাহিন। অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে বাসটি গন্তব্যে যাচ্ছিল। বাড়তি ভাড়া হিসেবে ২৫ টাকার জায়গায় ৪০ টাকা করে ভাড়া নিয়েছেন কন্ডাকটর। বাসটি মালিবাগে আবুল হোটেল স্টপেজের কাছে যেতেই দৌড়ে উঠে পড়েন কয়েকজন যাত্রী। হেল্পারও তাদের তুলে নেন। এতে বাসের অন্য যাত্রীরা ক্ষেপে যান। শুরু হয় বাগ্বিতণ্ডা। যাত্রী শাহিন বলেন, তারা যেই ভাড়ার কথা বললো সেই ভাড়াই দিলাম, কিন্তু কেন দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত যাত্রী তুললো? এটা মেনে নেয়া যায় না, যে কারণে কন্ডাকটরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছি। এই চিত্র শুধু তুরাগ পরিবহনের বাসেই নয়, ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর পর সকাল থেকেই রাজধানীর প্রায় প্রতিটি রুটেই বাসের যাত্রীদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। রামপুরা থেকে নতুন বাজার যাওয়ার জন্য রাইদা পরিবহনের বাসে উঠেছেন আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী বেলাল হোসেন। তিনিও ১০ টাকার ভাড়া ১৫ টাকা পরিশোধ করেছেন। এরপরও বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলায় তিনিও কন্ডাকটর ও চালকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছেন। এ যাত্রী বলেন, করোনা থেকে বাঁচার জন্য আমরা নিরাপদে থাকতে চাই, ওরা ভাড়া বাড়িয়েছে, সমস্যা হলেও আমরা তা মেনে নিয়েছি। ৬০ শতাংশ ভাড়া বেশি দিচ্ছি, তারপরও কেন তারা অতিরিক্ত যাত্রী নেবে? যাত্রীরা এ বিষয়ে কড়া প্রতিবাদ না করলে তারা ঠিক হবে না। আমরা সাধারণ যাত্রীরাই যাঁতাকলে পড়েছি সবদিক থেকে।

দরজা বন্ধ করে চলছে বাস : গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকেই বাস সংকট দেখা দেয় বিভিন্ন এলাকায়। এতে গন্তব্যে যেতে যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর গন্তব্যে যেতে যে বাস পাচ্ছেন তাতেই তারা উঠে পড়ছেন।

যা বলছেন বাস চালক-সহযোগীরা : সাভার থেকে মহাখালী, গুলশান হয়ে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত চলাচল করা বৈশাখী বাসের এক কন্ডাকটর বলেন, ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর পর আজ সকাল থেকে বারবার যাত্রীদের সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছে। সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। ভাড়া আদায় করা যেমন কষ্ট হচ্ছে তেমনি কোনো কারণে যদি দু-একজন অতিরিক্ত যাত্রী বাসে উঠে পড়েন, তাতে অন্য যাত্রীরা মারতে আসছেন, গালাগালিও করছেন। প্রায় সব বাসেই আজ যাত্রীদের সঙ্গে আমাদের বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে। তুরাগ বাসের চালক মিজান মিয়া জানান একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা। মালিবাগ থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত কথা হয় এই বাস চালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি বাসে অর্ধেক যাত্রী নিয়েই গাড়ি চালাতে। কিন্তু প্রতিটি স্টপেজে অতিরিক্ত যাত্রী গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষা করছেন। কোথাও কোথাও জোর করে যাত্রী উঠে যাচ্ছেন। তখন অন্য যাত্রীরা আমাদের মারতে আসছেন, কন্ডাকটরের সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছে, রাগ করে ভাড়া দিতে চাইছেন না যাত্রীরা। এই অবস্থায় বিপদে পড়েছি আমরা।

বিড়ম্বনায় স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা : নারায়ণগঞ্জ থেকে সাইনবোর্ড হয়ে শনির আখড়া-যাত্রাবাড়ীর কাজলায় ফ্লাইওভারে ওঠার মুখেই অপেক্ষা করতে দেখা যায় শতশত যাত্রীকে। অফিস সময় হওয়ায় যাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু তারা অসহায়ের মতো অপেক্ষা করছেন, কারণ কোনো বাসের দরজাই খুলছে না। আগেই অর্ধেক যাত্রী পূর্ণ হওয়ায় বাসগুলো গেট বন্ধ রেখে চলে যাচ্ছে, মাঝের স্টপেজে থামছে না। এতে অফিসগামী যাত্রীরা পড়েছেন বিড়ম্বনায়। বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা বলছেন, দীর্ঘ সময় আমরা এখানে অপেক্ষা করছি। বাসে ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের আদেশ আজ থেকে কার্যকর হওয়ার কারণে সব বাস যাত্রী পরিপূর্ণ করে গেট বন্ধ করে চলে যাচ্ছে। আমরা যারা মাঝপথ থেকে স্বল্প দূরত্বে যাব তারা পড়েছি বিপদে। হাজার হাজার যাত্রী বিভিন্ন স্টপেজে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠতে পারছেন না।

বাসে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না : ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়ায় ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি যেসব স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হয়েছে সেসবের অধিকাংশ বাসে মানতে দেখা যায়নি। যাত্রীদের জন্য রাখা হয়নি হ্যান্ডস্যানিটাইজার। অনেকে আবার মাস্ক ছাড়াই বাসে উঠছেন।

মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা : করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারে যে ১৮টি নির্দেশনা রয়েছে, এর আলোকে বাসে ৫০ শতাংশ সিটে যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এরই মধ্যে আগামী দুই সপ্তাহের জন্য রাইড শেয়ারিং সার্ভিস বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএ বলছে, করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে সেটা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামী দুই সপ্তাহ মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। গতকাল বিআরটিএর উপপরিচালক (প্রকৌশল শাখা) বিমলেন্দু চাকমা স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বিষয়টি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত (আপাতত দুই সপ্তাহ) রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনাও দিয়েছে বিআরটিএ।

লঞ্চেও ৬০ ভাগ বেশি ভাড়া আজ থেকে : করোনা সংক্রমণ বাড়ায় সরকারি নির্দেশনা মেনে নৌযানেও অর্ধেকে নামছে যাত্রী। সেই সঙ্গে ভাড়া বাড়ছে ৬০ শতাংশ। আজ বৃহস্পতিবার থেকেই কার্যকর হচ্ছে এ সিদ্ধান্ত। গতকাল অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গে লঞ্চ মালিকদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর খান বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত জনপ্রতি যাত্রী ভাড়া ঠিক করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা। আর কোনো যাত্রীর গন্তব্য ১০০ কিলোমিটারের বেশি হলে, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪০ পয়সা করে ভাড়া দিতে হবে। দু্ই পক্ষের সিদ্ধান্তে জনপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ টাকা। এর আগে বুধবার সকালে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক বৈঠকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। সচিবালয়ের ওই বৈঠক শেষে প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হলে অবশ্যই ভাড়া বাড়াতে হবে। বুধবারের মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ এবং লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ভাড়া নির্ধারণ করা হবে। আজ বৃহস্পতিবার থেকেই বাড়বে লঞ্চের ভাড়া। ভাড়া বাড়ানোর পাশাপাশি, পরিবহন সংখ্যাও বাড়ানো হবে। এরপর দুপুরে লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর বৈঠকে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। অর্ধেক যাত্রী পরিবহন ও স্বাস্থ্যবিধি না মানা হলে, লঞ্চ মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সতর্ক করেছেন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। পাশিপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেতে যাত্রীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আমার সংবাদের সৌজন্যে।