ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রেন থেকেই দুই বছরে ২৮৫ কোটি টাকা আয়

বাংলাদেশ রেলওয়েতে পণ্য পরিবহণে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আমদানীকারকদের নিশ্চিত করতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। তারপরও কেবল ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রেন থেকেই বিগত দুই অর্থ বছরে ২৮৫ কোটি টাকা আয় করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিম জোন। এর মধ্য শুধু ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রেন থেকেই এসেছে ২৪৭ কোটি টাকা। রেলের পশ্চিম জোনের আন্তর্জাতিক সীমান্ত পথে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। আর রেলওয়ের পশ্চিম জোনের এই সফলতার দেখেই রেলওয়ের পূর্ব জোনও পণ্য পরিবহনের বিষয়ে উৎসাহী হয়েছে।

তবে যমুনা নদীর ওপর রেলব্রীজ নির্মাণ কাজ শেষ হলে এবং পণ্য খালাসে স্টেশনগুলোতে পর্যাপ্ত সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হলে রেলওয়ের আয় আরো বৃদ্ধি পাবে বলে দাবি করেছেন পশ্চিম জোন রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিন। আর ভারত থেকে পণ্য আমদানীকারকদের দাবি শুধুমাত্র সীমান্ত পথ উন্মুক্ত করলেই হবে না। এর সঙ্গে রেল স্টেশনগুলো আধুনিকীকরণ, আমদানীকৃত পণ্য পরিবহণ ও পণ্য খালাসের জন্য প্রয়োজনীয় ইয়ার্ড নির্মাণ, ইয়ার্ডে ওজন স্কেল স্থাপন, নিরাপত্তা প্রদানসহ আমদানীসংশ্লিষ্ট সকল সুযোগ-সুবিধা রেলওয়েকে নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিম জোনের বিভিন্ন স্টেশনে সরেজমিন ঘুরে ও পাকশীয় বিভাগীয় রেলওয়ের বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রেলে পণ্য আমদানীকারকদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু সড়কপথের চেয়ে রেলপথে ট্রেনযোগে অপেক্ষাকৃত কম খরচে, ঝুট ঝামেলা ছাড়াই কঠোর নিরাপত্তায় পণ্য পরিবহণ করা যায় বলেই আমদানীকারকদের রেলের মাধ্যমে পণ্য আমদানীর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পাকশী বিভাগের দর্শনা, বেনাপোল, রহনপুর ও চিলাহাটি এবং লালমনিরহাট বিভাগের বিরল স্টেশন দিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে পণ্য আমদানী করছেন আমদানীকারকরা। পশ্চিম জোনের ১৭টি স্টেশনে আমদানী করা পণ্য খালাস করা হচ্ছে। তবে অধিকাংশ স্টেশনেই নেই আমদানী পণ্য খালাসের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। এ ছাড়া ফরিদপুর, আমিরাবাদ, মুধখালি, ছাতক, কাশিয়ানি-গোপালপুর, খুলনা, নোয়াপাড়া, যশোর, ভেড়ামারা, ঈশ্বরদী, মুলাডুলি, উল্লাপাড়া, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় সিরাজগঞ্জ ও পাবনা স্টেশন এবং উত্তরাঞ্চলের হিলি, সৈয়দপুর, শান্তাহার, পার্বত্যপুর স্টেশনে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আমদানীকারীদের চাহিদামোতাবেক যেকোনো স্টেশনে রেললাইন, ইয়ার্ড ব্যবস্থা দিয়ে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা করা হয়।

রেলওয়ের সূত্র মতে, রেলের স্টেশনগুলোতে পণ্য খালাসে রেল ইয়ার্ড, ওজন স্কেল, গাড়ি পার্কিংসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা না গেলেও শুধু সড়ক পথের চেয়ে তুলনামূলক ভাড়া কম ও পরিবহণের ঝামেলা কম। পণ্য নিয়ে ট্রেন ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে সাধারণত ৬৫ কিলোমিটার রাস্তার ভাড়া নেওয়া হয়। আর এই দূরত্বের যেতে প্রতিটন পণ্যের জন্য রেলওয়েকে ভাড়ার অন্যান্য ওজন, শুল্ক চার্জ ও বিশেষ সার্ভিস চার্জসহ মাত্র ৩৬৭ টাকা আমদানীকারদের ভাড়া দিতে হয়। (যা প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (সিসিএম) কর্তৃক নির্ধারিত)। রাজশাহী অফিস থেকে নির্ধারণ করা হয়। যা সড়ক পথের ভাড়ার চেয়ে অনেক কম। এই কারণে পণ্য আমদানী করার ক্ষেত্রে ক্রমেই রেলের চাহিদা বাড়ছে। তবে ঈশ্বরদী স্টেশন হয়ে বাইপাস স্টেশন থেকে ঢাকা স্টেশন পর্যন্ত রেলের সিঙ্গেল। একই সঙ্গে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলে খুবই সমস্যা হয়। পণ্যবাহী ট্রেন স্টেশনে থামিয়ে রেখে যাত্রীবাহী ট্রেন পার করতে হয়। যার কারণে পণ্যবাহী ট্রেন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সময় পর গন্তব্যে পৌঁছায়। এটাও আমদানিকারকদের জন্য সমস্যা।

ঈশ্বরদী পশ্চিম জোন রেলওয়ের একটি অন্যতম বৃহত্তম জংশন স্টেশন। এই স্টেশনে প্রতিদিন ভারত থেকে আসা ভুট্টা, গম, চাউল, ডাল, তেল, পাথর খালাস করা হয়। কিন্তু এখানে আমদানীকৃত পণ্য খালাসের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এ জন্য পণ্য খালাসের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় আমদানীকারকদের। ভারত থেকে এ দেশে আসা পণ্য ৪০টি পয়েন্টে ১৭টি বুকিং স্টেশনে খালাস করা হয়। কিছু স্টেশনে খালাসের সুবিধা কম। অন্য স্টেশনগুলোতে এক সঙ্গে ১০টি রেলের ওয়াগন খালাস করা যায়। এক সঙ্গে ৫টি ট্রাকও বের হতে পারে।

কৃষি পণ্য আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান ঈশ্বরদীর আরআরপি ফিডের পণ্য খালাসে নিয়োজিত শ্রমিকদের সর্দার তহুরুল ইসলাম মানিক জানান, ঈশ্বরদী স্টেশনে রেলওয়ের প্রচুর জায়গা রয়েছে। কিন্তু অবৈধ দখলদাররা সমস্ত জায়গা দখল মার্কেট তৈরি করেছে। এই কারণে একই সময়ে এখানে একটির বেশি ট্রাক লোড দেওয়া যায় না। একটি লোড হয়ে গেলে সেটি চলে যাওয়ার পর আরেকটি ট্রাক ট্রেনের ওয়াগনের সঙ্গে ভিড়ানো হয়। স্টেশনে পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় পণ্যবাহী ট্রেন খালাস করতে দীর্ঘদিন সময় লেগে যায়।

সর্দার তহুরুল ইসলাম মানিক মানিক আরো জানান, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের প্রতিষ্ঠান ভারতীয় ৫২টি ওয়াগনে ৫০০ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্য পণ্য আমদানী করে। তিন থেকে চার দিনের মধ্যে আমদানী করা পণ্যগুলো খালাসের সক্ষমতা তাদের রয়েছে। কিন্তু স্টেশনে পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা না থাকায় সেগুলো খালাস করতে ৩ থেকে ৪ দিনের জায়গায় ১০ থেকে ১২ দিন সময় লেগে যাচ্ছে।

স্টেশন এলাকায় রেলের পর্যাপ্ত জায়গা থাকলেও এসব জায়গা বেদখল হয়ে রয়েছে। অথচ পার্কিংয়ের জায়গার অভাবে ভোগান্তিতে রয়েছেন আমদানিকারকরা। পণ্য খালাসের জন্য রেলওয়ের ইয়ার্ড সম্প্রসারণসহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার দাবিও জানান মানিক।

রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন করা গেলে বিদেশী পণ্য পরিবহণ আরো বাড়বে বলে জানান আমদানীকারকরা। এ ব্যাপারে রেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইতিমধ্যে রেলওয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলমান। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সব সমস্যার সমাধান হবে।

রেলওয়ে পশ্চিমজোনের পাকশী বিভাগের বিভাগীয় বাণিজ্য কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন জানান, আমদানীকারকদের স্বার্থে রেল কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই যেসব স্টেশনে পণ্য খালাস হয় সেগুলোর আধুনিকায়নের কাজ শুরু করেছে। খালাসের স্টেশনগুলোতে রেল ইয়ার্ড ও গোডাউন সুবিধা বৃদ্ধি করে আমদানীকারকদের সুবিধা প্রদানের প্রচেষ্টা রেলওয়ের অব্যহৃত আছে।

তিনি আরো জানান, ঈশ্বরদী থেকে ঢাকার সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ সহজ করতে ডবল লাইন স্থাপনের লক্ষ্যে যমুনা নদীতে রেল সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে ভারত থেকে দর্শনা ও হিলি সীমান্ত দিয়ে আসা পণ্যবাহী ট্রেন সরাসরি পূর্বাঞ্চলের চট্রগ্রাম পোর্টসহ অন্যান্য এলাকায় নিয়ে যাওয়া সহজ হবে বলে জানান। তখন আমদানিকারকদের আর সমস্যা হবে না। একই সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের চলাচলও আরাম দায়ক হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। (তথ্য সংগ্রহ: আমাদের ঈশ্বরদী)