মহিমান্বিত ও বরকতপূর্ণ ‘লাইলাতুল কদর’
‘লাইতুল কদর’ আরবি শব্দ। ফারসিতে ও উর্দুতে বলে শবে কদর। এর অর্থ অতিশয় মর্যাদাপূর্ণ সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা মহাপবিত্র রজনী।
এ রাত্রিকে ‘লাইলাতুল কদর’ হিসেবে নামকরণ করার কারণ হলো এ রজনীর মাধ্যমে উম্মতে মুহম্মদীর সম্মান বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ রাতে মানবজাতির তাকদির পূন:নির্ধারণও করা হয়।
তাই এ রাত অতি পূন্যময় ও মহাসম্মানিত। এ গৌরবময় রজনীতে মানবজাতির পথ প্রদর্শক ও মুক্তির সনদ মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়কর মহাপবিত্র ঐশীগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ন হয়েছে।
লাইলাতুল কদর মহিমান্বিত, বরকতময় ও বৈশিষ্ট্য মন্ডিত এ জন্য যে, এ রাতের শ্রেষ্ঠত্ব মহাত্ম্য ও মর্যদা সর্বপ্রনিধানযোগ্য। শবে কদর কোরআন নাযিলের রাত। রমজান মাসের এ রাতে পবিত্র মক্কা মুকাররমার হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে হযরত জিবরাইল (আঃ) এর মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি মহাগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ন হয়। কদরের রাতে আল কোরান লওহে-মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে নাযিল করা হয়। (দ্রষ্টব্যঃ সুরা বাকারাহ- ১৮৫ ও সুরা দুখান-৩)।
রাসুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন- ‘তোমরা এমন একটি মাস পেয়েছো, যাতে এমন একটি রজনী রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম’ (মেশকাত)। রমজান মাসে রয়েছে আল্লাহ তাআলার অপার করুণার পরম পূর্ণতার মহিমান্বিত রজনী ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর’ তথা মহা মর্যাদাপূর্ণ সম্মানিত রাত। শব অর্থ রাত, আর কদর অর্থ মর্যাদা, শবে কদর অর্থ মর্যাদার রাত। কোরআনের ভাষায়- এ রাতের নাম ‘লাইলাতুল কদর’ মর্যাদাপূর্ণ মহিমান্বিত রাত। আল কোরআনেরই সংস্পর্ষে এ রাত ‘লাইলাতুল’ কদর বা ‘শবে কদর’ রজনীর অসাধারণ সম্মানে ভূষিত হয়েছে। কোরআনের সঙ্গে যার যত বেশি সম্পর্ক, সংস্পর্ষ ও সান্নিধ্য থাকবে, তিনি তত বেশি সম্মান্নিত মর্যাদার অধিকারী হবেন। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন- ‘কোরআনওয়ালাই আল্লাহওয়ালা এবং তার খাস ব্যক্তি ও পরিবারভূক্ত।’ হাদিস শরীফে আরো এসেছে- ‘যার অন্তরে কোরআনের সামান্যতম অংশও নেই, সে যেন এক বিরাণবাড়ি’ (মুসলিম)। রাসুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি শবে কদরে আল্লাহ’র প্রতি বিশ্বাস রেখে পূণ্যের আশায় ইবাদত করে তার পূর্বকৃত সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়’ (বুখারী মুসলিম)।
একদিন নবী করিম (সা:) বনী ইসরাইলের শামউন নামের একজন আবিদ-জাহিদের দীর্ঘকালের কঠোর সাধনা সম্পর্কে বলছিলেন। সেই মহৎ ব্যক্তি একহাজার মাস লাগাতর দিবাভাগে সিয়াম ও জিহাদে লিপ্ত থাকতেন এবং সারারাত জেগে আল্লাহর ইবাদতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর এক নেক বান্দার কঠোর সাধনার কথা শুনে বলতে লাগলেন হায়! আমারও যদি ঐ লোকটির মতো দীর্ঘায়ু পেতাম তাহলে আমরাও ঐ রকম ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে দিনরাত অতিবাহিত করতে পারতাম। তখন মহান দয়াময় আল্লাহ কোরআন কারিমে সুরা আল-ক্বাদর নামে একটি স্বতন্ত্র সুরা নাযিল করলেন। এই সুরায় তিনি বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আমি এটা (কোরআন) কদর রাতে নাযীল করলাম। আর আপনি কি জানেন, মহিমান্বিত রাত কি? কদর (মহিমান্বিত) রাত, হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে প্রত্যেক বরকতপূর্ণ বিষয় নিয়ে ফেরেশতা ও রুহ (জিব্রাইল) (দুনিয়াতে) অবতীর্ণ হয় স্বীয় রবের নির্দেশে। সেই রাতে সম্পূর্ণ শান্তি ফজর পর্যন্ত বিরাজিত থাকে।’ (সুরা- ক্বাদর, আয়াত ১-৫)।
ইবনে আবী হাতেম (রা:) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (স:) একবার বণী ইসরাইলদের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। তিনি একহাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকতেন এবং কখনও অস্ত্র সংবরণ করেন নি। মুসলমানরা এ কথা শুনে বিষ্মিত হলে এই সুরা নাযিল হয়। এতে উম্মতের জন্য শুধু এক রাতের ইবাদতই সেই মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতীয়মান করা হয়েছে। ইবনে জরীর (রা:) অপর একটি ঘটনা এ ভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বনী ইসরাইলের জনৈক ব্যক্তি সারারাত ইবাদতে মশগুল থাকতেন ও রোজা রেখে সকাল হলেই জিহাদের জন্য বের হয়ে যেতেন এবং সারাদিন জিহাদে লিপ্ত থাকতেন। তিনি এভাবে এক হাজার মাস পার করে দিতেন। এই প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তায়ালা এই সুরা কদর নাযিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। শবে কদরে কোরআন নাযিলের জন্য এ মহিমান্বিত রাত্রিকে আল্লাহ তাআলা অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন। এই একটি মাত্র রজনীর ইবাদত বন্দেগিতে হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রæতি দেওয়া হয়েছে।
পবিত্র শবে কদরকে লইলাতুল কদর বলে। শবে কদর মাসে মর্যাদা প্রাপ্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধির রাত। যারা তওবা করে পবিত্র রমজানের সিয়াম সাধনা ইবাদত বন্দেগি করে তারা কদর লাভ করবে। আল্লাহর নিকট তাদের মর্যাদা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। শবে কদর নিজেই মহিমান্বিত রাত। শবে কদর যারা লাভ করবে তাদের মর্যাদাও শবে কদর বাড়িয়ে দিবে। এ রাতে আল্লাহ তার বান্দার তওবা কবুল করেন। বান্দার গুনাহ ক্ষমা করে দেন। তাই সবার উচিত মধ্য সাবান মাস থেকে শবে কদর পর্যন্ত বেশী বেশী তওবা, এস্তেগফার ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ শান্তির ব্যবস্থা করা। যারা রমজান মাসে এবং শবে কদরে তওবা করবে, ইবাদত-বন্দেগি করবে, তাকওয়ার মাধ্যমে অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে ও ভালবাসায় নিজেকে সংশোধন করবে তারাই প্রকৃত মুমিন।
লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট রাত সম্পর্কে আলেম সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুযায়ী রমজানের শেষ দশ তারিখের কোন একটি বেজোড় রাত হচ্ছে এই কদরের রাত। আবার তাদের মধ্যেও বেশির ভাগ আলেমের মত হচ্ছে সেটি রমজানের সাতাশ তারিখের রাত। বর্ণিত নির্ভরযোগ্য হাদিস গুলির আলোকে হজরত আবু হুরায়রা বর্ণনা করেছেন- রাসুলুল্লাহ (স:) লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেন: সেটি সাতাশের বা ঊনত্রিশের রাত (আবু দাউদ)। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) এর অন্য একটি রেওয়াতে বলা হয়েছে- সেটি রমজানের শেষ রাত (মাসনাদে আহমদ)। তবে মাআরিফুচ্ছানাম কিতাবে শবে কদরের ইবাদতের জন্য ২৭ তারিখের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
লাইলাতুল কদরে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মাগফিরাত, নাজাত ও ক্ষমা পাওয়ার পরম সুযোগ লাভ করা যায়। লাইলাতুল কদর গোটা মানবজাতির জন্য অত্যন্ত পূন্যময় রজনী। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি এই রাত ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করবে আল্লাহ তার পূর্বের যাবতীয় গুনাহখাতা মাফ করে দিবেন। অপর হাদিসে বর্ণিত- যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে আত্মসম্পর্কিত হৃদয় নিয়ে ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাবে আল্লাহ তার ইজ্জত ও মর্যদা বহুগুন বাড়িয়ে দিবেন। রমজান ও শবে কদর মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি, সম্প্রীতি ও মানবতাবোধ সৃষ্টি করে।
লেখক :
আলহাজ্ব প্রফেসর মো.আবু নসর
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয় সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড।
সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঢাকা।
মোবাইল- ০১৭১৭-০৮৪৭৯৩।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন