মুম্বাইয়ের ফ্যাশন উইক-এ মোটা মেয়েদের র‌্যাম্প!

এবার ভারতের মুম্বাইয়ে বিখ্যাত ফ্যাশন উইক-এ হাঁটবেন প্লাস সাইজ মডেলরা। আগামী ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক’-এ কয়েকজন ‘প্লাস সাইজ’ মডেল র‌্যাম্প কাঁপাতে যাচ্ছেন। তাদের নিয়েই রইল কিছু আলোচনা।

কেজলিন খোলি, বয়স: ২২, অরুণাচল প্রদেশ:
অরুণাচলের প্রথম মডেল কেজলিন। তার প্রদেশ থেকে কেউ কখনও এর আগে মডেলিং করেননি। পড়তে এসেছিলেন মুম্বাইয়ে। তারপর সেখানেই চাকরি। ইমেজ আর এটিকেট কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন তিনি। ইটানগর থেকে মুম্বাই—যাত্রাটা মোটেই সহজ ছিল না তার। কেজলিন বলেন, ‘একে তো মেয়ে তারপর মোটা, ফলে চেহারা নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে অনেক। কিন্তু ইমেজ কনসালটেন্ট হিসেবে আমি সবাইকে বলি নিজের শরীরকে ভালোবাসো। ওজন কখনো কোনো কিছুর অন্তরায় হতে পারে না। নিজেও মনে প্রাণে সেটাই বিশ্বাস করি। ভবিষ্যতেও মডেলিং করার ইচ্ছে রয়েছে তবে ওজন না কমিয়েই। ’

ফিজা খান, বয়স: ২২, মুম্বাই:
১৬-১৭ বছর বয়সে জিরো সাইজ মডেল হিসেবে র‌্যাম্প হাঁটতেন তিনি। কিন্তু তারপর নানা কারণে ওজন বাড়তে থাকে। কিছুটা হতাশা আবার কিছুটা একেবারে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, দুইয়ে মিলে এখন ওজন ১৫০ কেজি। আইনের এই ছাত্রী কিন্তু তাও র‌্যাম্প ছাড়েননি। তিনি বলেন, ‘এখন আমি প্লাস সাইজ মডেল হিসেবেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তবে ওজনটা একটু কমাতে চাই। কারণ বেশি ওজনে খুব কষ্ট হয়। অতিরিক্ত মেদ কিছুটা ঝরে গেলেই আমি খুশী। আর জিরো সাইজ নয়, কার্ভি মডেল হিসেবে র‌্যাম্প হাঁটতে চাই। আমি আফগানী। তাই স্ট্রাকচারটাও চওড়া। সেইভাবেই নিজেকে রাখতে চাই’

অদিতি মুনি, বয়স: ৩৮, মুম্বাই:
তিনি হোমমেকার। দুই সন্তানকে নিয়ে ভালোই কাটছিল জীবন। হঠাতই বিজ্ঞাপন দেখেন প্লাস সাইজ মডেল অডিশনের। একপ্রকার জোর করেই তাঁকে তাঁর সঙ্গী পাঠান এই অডিশনে। একদিকে বাড়ির রেনোভেশন চলছে, অন্যদিকে অডিশন, ফলে আর পাঁচজন মহিলার মতো প্রথমটাই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যও হয়তো একটু অন্যরকম পরিকল্পনা করে রেখেছিল। ‘বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। ইচ্ছেও ছিল অডিশন দেওয়ার। কিন্তু বাড়িতে কাজ চলছিল। তারপর বাচ্চাদের স্কুল। একজনের বয়েস ৮, একজনের ৯। ফলে পুরো খেয়াল রাখতে হয় ওদের। আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। অডিশন শুরু হবে ১১টায়। এদিকে ১টার সময় বাচ্চাদের স্কুলের ছুটি।

হঠাৎই নিখিল, আমার হাজব্যান্ড বলেন এই সব ঘরোয়া কাজের জন্য এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়৷ ফলে ও বাড়ি সামলায়, আর আমি যাই অডিশন দিতে। ’ ফ্যাশন ডিজাইনিং-এর ছাত্রী অদিতি একসময় ওয়েন্ডেল রডরিক্স-এর কাছে ডিজাইনিং শিখেছেন। এবার তাঁর পোশাকেই র‌্যাম্প হাঁটার পালা। ফলে স্বভাবতই উৎসাহিত তিনি।

রজত খান্না, বয়স: ২৯, দিল্লি:
রজত অনেক দিন ধরেই প্লাস সাইজ মডেলিং করছেন। বেশ কয়েকটা নামী ব্র্যান্ডের হয়েও মডেলিং করেছেন তিনি। তারপর হঠাৎই ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখেন অডিশনের। আর দেরি করেননি। ব্যাগ গুছিয়ে সোজা পাড়ি দেন মুম্বাই। রজতের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘বিজ্ঞাপনটা দেখেই আমি মুম্বাইয়ে যাওয়ার ট্রেনের টিকিট কাটি। মুম্বাইয়ে আমার কোনও পরিচিত কেউ থাকে না। একটা অনলাইন সাইট থেকে রুম বুক করি। অডিশন দেই। বেশ কষ্ট করতে হয়। তাই র‌্যাম্প হাঁটার সুযোগটা আমার কাছে ছিল একেবারে গাজরের হালুয়ার মতোই সুস্বাদু। ‘ এই প্রথম কোনো নামী ডিজাইনারের হয়ে র‌্যাম্প হাঁটবেন রজত। তেমন কাজের সুযোগ পেলে পাকাপাকি ভাবে মুম্বাই থেকে যেতেও আপত্তি নেই তাঁর।

নেহা পারুলকর, বয়স: ২৫, মুম্বাই:
মোটা বলে ছোট থেকেই বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, ভাইবোনদের কাছে হাসির খোরাক হতে হয়েছে তাঁকে। কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে কখনও যেতেন না তিনি। ওজনও অনেক, ১০০ কেজি। যাঁর সঙ্গেই দেখা হত, তিনিই জ্ঞান দিতেন রোগা হওয়ার জন্য। কিন্তু তারপরেই বদলায় সব কিছু। একটি লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন সুইমসু্ইট ইসু্য বের করছিল। সেখানে বিভিন্ন বডি টাউপের মডেল প্রয়োজন ছিল। এক বন্ধুর মাধ্যমে যোগাযোগ হয় সেই ম্যাগাজিনের সঙ্গে। ব্যস, তারপর বদলে যায় পুরোটা। তিনি বলেন, ‘আমাকে যখন সুইম সু্যট শ্যুট করার কথা বলা হয়েছিল আমি ভয়ে আর যোগাযোগ করিনি। কীভাবে আমি আমার থাই, মোটা হাত দেখাবো? আর স্টমাকও ফ্ল্যাট নয়! আমার পোশাকের সাইজ ২৪। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে রাজি করিয়ে ফেলেন ওঁরা। আশ্চর্যের বিষয়, আমাকে একটুও দেখতে খারাপ লাগেনি। ইনস্টাগ্রামে আমি ছবিগুলো পোস্ট করি। খুব ভালো রেসপন্স পাই। কেউ বডি শেমিং করেনি। আর তারপরেই ডাক পাই ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক’-এর অডিশনের। এখন আমাকে যদি কেউ মোটা বলেন, হেসে উড়িয়ে দিই। কারণ মোটা হয়ে যদি অন্যরকম কিছু করতে পারি তাহলে রোগা হতে যাব কেন?’

প্রিন্স খুরানা, বয়স: ৩০, থানে:
পারিবারিক ব্যবসা সামলান তিনি। সারক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় ব্যবসার কাজে। ভবিষ্যতেও সেটাই করবেন। মডেলিং করার তেমন ইচ্ছেও নেই। তবুও বন্ধুরাই ধরে বেঁধে পাঠায় অডিশনে। কারণ একবার অন্তত র‌্যাম্প হাঁটার ইচ্ছে ছিল তাঁর। ‘আমি কিছুই জানি না র‌্যাম্পের। কিন্তু ইচ্ছে ছিল মডেলিং করার। তারপর আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বন্ধুদের জন্য সেই সুযোগ পাই। কেমন লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। তবে এটাও ঠিক ভবিষ্যতে কোনো ভালো কাজের জন্য র‌্যাম্পে হাঁটতে হলে তাবেই হাঁটব। টাকার জন্যে নয় তবে এখন নিজেকে ফ্যাশন উইকের জন্য তৈরি করছি মন দিয়ে। ‘

কিঞ্জল শাহ, বয়স: ৩২, মুম্বাই:
তিনি গান শেখান। মিউজিক কোঅর্ডিনেটর হিসেবেও কাজ করেন। অভিনয়ও করেন টুকটাক। তাই ফ্যাশন দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আগে থেকেই। ওজন নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি। কেউ বললেও পাত্তা দেননি। তিনি বলেন, ‘আমাকে বহুবার বহু মানুষ বলেছেন ওজন না কমালে এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার কিছু হবে না। নিজের শারীরিক গঠনের বিপরীতে গিয়ে কিছু করতেও চাইনি কোনোদিন। রোগা হলেই আমার কাছে কাজের বন্যা বইবে, এই মানসিকতা যাঁদের, তাঁদের জন্য সত্যিই দুঃখ হয়। ‘

আশাকরি বুঝতে পারছেন ওজন কোনো কিছুরই অন্তরায় নয়। সুস্থ আর খুশী থাকাটাই আসল। তাই বাঁচুন প্রাণ খুলে আর নিজেকে বলুন, বডি শেমিং? সেটা আবার কী?

ওয়েন্ডেল রডরিক্স, ফ্যাশন ডিজাইনার:
‘ডিজাইনারের কাজই হল সব ধরনের বডি টাইপকে ভালোবাসা। এটাই ‘ফ্যাশন ডেমোক্রেসি’। তাই এবার প্লাস সাইজ পোশাক বানাতে পেরে আমি সত্যিই খুব খুশি। ফ্যাশন কোনো এক প্রকার মানুষের জন্য নয়। কোন বয়সে কে কোন রঙের পোশাক পরবেন, কোন ওজনে তিনি কী পোশাক বাছবেন এটা একেবারেই তাঁর ব্যক্তিরুচি। এই নিয়ে যাঁরা কথা বলেন তাঁরা কিন্তু ফ্যাশনটা বোঝেন না। ফ্যাশন ডিজাইনারের কাজই হল স্বাভাবিক সৌন্দর্য্যটা বজায় রাখা। ‘