যেভাবে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ঠাঁই পেল আদিবাসীদের লড়াই

বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন করা হবে বুধবার। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের ৯০টি দেশে প্রায় ৩৭ কোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। যারা স্বাধিকার, নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব জাতীয়তাবোধের জন্য লড়ছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী আদিবাসী। কিন্তু বিশ্বের মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ১৫ শতাংশই আদিবাসীদের।

বর্তমান বিশ্বে সাত হাজারটি ভাষা প্রচলিত আছে; এর মধ্যে চার হাজারটি ভাষা এই আদিবাসীদের। পাঁচ হাজারেরও বেশি নিজস্ব সাংস্কৃতিক রীতিনীতি রয়েছে তাদের। আদিবাসীরা অনন্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী এবং সেই সংস্কৃতির চর্চা করছে। তারা নিজস্ব সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য লালন করছে; যা প্রাধান্যশীল সমাজের থেকে আলাদা। সাংস্কৃতিক ভিন্নতা থাকা স্বত্ত্বেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আদিবাসীদের সমস্যার জায়গা প্রায়ই একই; সেটি হচ্ছে অধিকারের সুরক্ষা।

আদিবাসী জনগণ বছরের পর বছর ধরে তাদের পরিচয়, জীবন যাপনের পদ্ধতি, বংশ পরম্পরায় জমির মালিকানা, ভূখণ্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারের স্বীকৃতি দাবি করে আসছে। ইতিহাস বলছে, সভ্য এই সমাজে এখনো তাদের অধিকারের লঙ্ঘিত হচ্ছে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে অরক্ষিত এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী হচ্ছে আদিবাসীরা।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন স্বীকার করছেন যে, তাদের অধিকার সুরক্ষা, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি এবং জীবনধারা টিকেয়ে রাখার স্বার্থে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। আদিবাসীদের এই স্বীকারের স্বীকৃতি আটকে আছে দেশে দেশে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বুধবার বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষ্যে এবছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের এক দশক।’

১০ বছর আগে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। বহুল প্রতিক্ষীত এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার, আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার, ভূমি, অঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পূর্ণ অধিকার এবং ভূমির উপর ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের স্বীকৃতি দেয়া হয়। একই সঙ্গে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, শিক্ষা, নিজস্ব ভাষা, জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও সুরক্ষার স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ।

গত দশকে জাতিসংঘের এই ঘোষণার বেশ কিছু অংশ জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য অর্জন করেছে। এ সাফল্য সত্ত্বেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও নীতির প্রাথমিক বাস্তবায়নের মাঝে বিশাল ব্যবধান রয়েছে।

৩৫ বছর আগে ৯ আগস্ট আদিবাসী নেতারা তাদের জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষার লক্ষ্যে জাতিসংঘে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। আদিবাসীরা সব দেশেই অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আলাদা। তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে, সংস্কৃতি রয়েছে। এই আদিবাসীরাই একমাত্র জনগোষ্ঠী যাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। এ কারণেই আদিবাসীরা তাদের দেশের সরকারের কাছে স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন।

বিশ্ব পরিমণ্ডলের আদিবাসীদের কণ্ঠস্বর প্রথম শোনা যায় ১৯২৩ সালে। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রের ‘কায়ুগা নেটিভ আমেরিকান’ গোত্র প্রধান দেশকাহেহ বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আদিবাসী জনগণের পক্ষে কথা বলতে লীগ অব নেশনসের বৈঠকে যান। কিন্তু সেই সময় আদিবাসী এই নেতাকে লীগ অব নেশনসের পূর্ণ অধিবেশনে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।

ওই সময় নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী নেতারাও দেশকাহেহ’র পথে হাঁটেন। কিন্তু তাদের সঙ্গেও একই ধরনের আচরণ করা হয়। লীগ অব নেশনসের বিবর্তন ঘটে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের সৃষ্টি হলেও এখনো পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি।

১৯৫০ সালে আদিবাসী ইস্যুকে ‘অনুন্নত সমাজের’ প্রাথমিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্ব সম্প্রদায়। ১৯৫৭ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক প্রথম সম্মেলন হয় জাতিসংঘে। এসময় সমস্যা জর্জরিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন আন্তর্জাতিক রূপ নেয়। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ নর্ডিক রাষ্ট্রগুলোর আদিবাসী রাজনীতিকরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন নিজ নিজ দেশে। তারা আন্তর্জাতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দেশীয় সীমান্ত অতিক্রম করে বিশ্ব মানুষের কাছে পৌঁছান।

উত্তর আমেরিকার নেটিভ নেতাদের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালে আদিবাসীদের অধিকারবিষয়ক প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব ইনডিজিনাস পিপলস’র সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে এই সংগঠনটি স্বীকৃতি লাভ করে। আদিবাসীদের বিরুদ্ধে শতাব্দী প্রাচীন সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাসে ৩৫ বছর খুবই স্বল্প সময়। বর্তমানে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নিপীড়িত ও বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর অনেক রাজনীতিক কাজ করছেন। কিন্তু তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই দিনে দিনে বেড়েছে।

আদিবাসী রাজনীতিবিদরা বিশ্ব সম্প্রদায়কে বলছেন, শান্তিতে বাস করতে হলে বিশ্বের একটি অংশের জনগোষ্ঠীকে সমৃদ্ধ করার পরিবর্তে দুর্বল করার পথে হাঁটলে তাতে সুখকর কিছু হতে পারে না। তবে কোনো জাতি বা রাষ্ট্র সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারে না; কারণ মহাবিশ্বের কোনো গোষ্ঠীর চাহিদা একটি বিশেষ স্থানে পূরণ হতে পারে না।

মহাবিশ্ব একটি মহাজাগতিক সম্পর্ক ব্যবস্থা। যেখানে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মানুষ, প্রকৃতি, প্রাণী ও অন্যান্য বস্তু ব্যাপক পরিসরে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে টিকে আছে। তবে একত্রে বসবাস করতে হলে এই স্বাধীন উদ্দেশ্যর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সূত্র : ইউএন ডট ওআরজি, লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস।