রংপুরের মিঠাপুকুরে ‘আলীপুর সর:প্রা: বিদ‍্যালয়’ শিশুদের নেশার মতো টানে

নৈতিকতা, পড়াশোনা, শিক্ষাদান,বিনোদন উপস্থিতিসহ শিশু শিক্ষায় অনন্য দৃষ্টান্ত রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিকে ঘিরে বদলে গেছে স্থানীয় জনপদ। এখানকার শিশু শিক্ষার্থীরা বাড়ি ফিরে নয়, আনন্দ আয়োজনে পড়াশোনা করে শ্রেণিকক্ষেই।

গত বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, সাদামাটা একটি গ্রাম আলীপুর। অথচ আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর ও মনোরম। কিছু শিশু মনের আনন্দে খেলা করছে বিদ্যালয়ের মাঠের ফাঁকা জায়গায়। বিদ্যালয়টির ভেতরের দৃশ্যও নান্দনিক। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা রয়েছে স্বাধীনতার মহান পুরুষ ও শহীদদের প্রতিকৃতি, কবি-সাহিত্যিক, বাঘ, ভালুক, ময়ূর, চিত্রা হরিণ, খরগোশ, হাতি, বক, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রাণীর ছবি। তাছাড়া শিশুদের জন্য বিভিন্ন খেলনাসামগ্রী দিয়েও শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এর মধ্যে সুশাসন ও শুদ্ধাচার সততা স্টোর, রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কর্নার, মানবতার দেয়ালও উল্লেখযোগ্য।

শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা প্রত্যন্ত গ্রামের এই বিদ্যালয়টি শিক্ষা বিস্তারে অন্যন্য অবদান রাখছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২সালে।কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা ছিল শোচনীয়।২০১৫ সালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন মো. নজরুল ইসলাম। এরপর ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে বিদ্যালয়ের পরিবেশ, ও নিয়মনীতি। পরিবর্তন আসতে শুরু করে বিদ‍্যালয়টিতে। সরকারি অর্থের পাশাপাশি স্থানীয়রাও সহায়তা করেছেন বিদ্যালয়ের এ পরিবর্তনের যাত্রায়।বিদ‍্যালয়টিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬৭। রয়েছেন সাতজন শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাছাড়া নিশ্চিত রয়েছে শতভাগ উপস্থিতি।

শিক্ষকরা জানান, শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে শিশুদের পড়ানো হয়, যাতে তারা আগ্রহী হয়ে ওঠে। শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় বিনোদনের মাধ্যমে। সে কারণে তারা বাড়ির চেয়ে স্কুলে থাকতেই বেশি পছন্দ করে।

শিক্ষার্থী লিতুনজেরার কথায়, বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক খেলার সামগ্রী আছে। শিক্ষকরা আমাদের ‘মা’ বলে ডাকেন। তাই প্রতিদিনই আমি স্কুলে আসি।

শিক্ষার্থী মাহিদুল ইসলামের কথায়, স্কুল আমাদের কাছ কতখানি আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। প্রতিদিনই বিদ্যালয়ে না এলে ভালো লাগে না। পড়াশোনার পাশাপাশি সহপাঠ কার্যক্রমের মাধ্যমে নৈতিকতার বোধ জাগ্রত করেন শিক্ষকরা।

৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাশেক রসুল জানায়, সে আগে ঢাকার একটি বিদ্যালয়ে পড়তো। বাবা-মা তাকে গ্রামে এনে স্কুলে ভর্তি করবেন শুনে প্রথমে তার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই বিদ্যালয়ে এসে ধারণা পাল্টে যায়। শহরের স্কুলের চেয়ে এখানকার পড়াশোনাও অনেক ভালো।

শুধু লিতুনজেরা বা মাহিদুল নয়, শিশু থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষার্থীর পছন্দের স্কুল আলীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হোমায়রা খানম বলেন, আমি আগে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। এছাড়া, অনেক বিদ্যালয় দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো এমন সুন্দর পরিবেশ আমি আগে দেখিনি। স্কুলের বাহ্যিক পরিবেশ, শিক্ষা উপকরণ, প্রধান শিক্ষকের স্কুল পরিচালনার কৌশল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।

অভিভাবক আমিনুল বুলবুল বলেন, এটি যেন বিদ্যালয় না, অফুরন্ত মজার কোনো জায়গা। আমার ছেলে বাড়িতেই থাকতে চায় না। এমন কি শুক্র-শনিবারেও স্কুলে আসতে চায়।

আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম আওয়ার নিউজ বিডি কে বলেন, দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এলাকাবাসীকে সম্পৃক্ত করে ব্যতিক্রমী কিছু করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভালো কাজে মানুষ অবশ্যই সহায়তা করে। আমাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতো শিক্ষা দেওয়া হয়।

স্থানীয় কাফ্রিখাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.জয়নাল আবেদিন বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত এই বিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে পুরো মিঠাপুকুর উপজেলা তথা রংপুর জেলা জুড়ে। আমার ইউনিয়নে এমন একটি বিদ্যালয় আছে, বিষয়টি গর্বের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে প্রয়োজনে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন এই জনপ্রতিনিধি।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আক্তারুল ইসলাম মনে করেন, একজন প্রধান শিক্ষকের সদিচ্ছা থাকলে কেবল বিদ্যালয় নয়, গোটা এলাকায় পরিবর্তন আসতে পারে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

ইউএনও মো.রকিবুল হাসান বলেন, শিক্ষা খ‍্যাতে দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বিদ্যালয়ের দেয়ালে নানা ছবি, বর্ণনায় তাদের জ্ঞানের দুয়ার সহজে খুলে যাচ্ছে। পাঠের সঙ্গে নানা উপকরণ ব্যবহারে শিশুদের একঘেয়েমি বা বন্দিদশায় থাকতে হচ্ছে না। বিদ্যালয় হয়ে উঠেছে শিশুদের জন্য আনন্দমুখর।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আদলে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হলে পাল্টে যাবে শিক্ষার পরিবেশ। শিশুরা নৈতিক শিক্ষায় বড় হয়ে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে উঠবে, এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।