লাশের মিছিলে আচ্ছন্ন মিয়ানমার, একদিনেই নিহত ৭১

মিয়ানমারে জান্তা সরকার বিরোধী বিক্ষোভে রোববার (১৪ মার্চ) একদিনেই নিহত বেড়ে ৭১ জন হয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর এর আগে একদিনে আর এত মানুষ নিহত হয়নি। সবমিলিয়ে সোমবার পর্যন্ত সরকার বিরোধী বিক্ষোভে ১৬৭ জন নিহত হয়েছে।

গত রোববার নিহত হওয়াদের অধিকাংশই ইয়াঙ্গুনের পশ্চিমে হ্লেইং থারইয়ার টাউনশিপের বাসিন্দা। সেখানে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী তাজা গুলি, কাঁদানে গ্যাস এবং স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করেছে। সোমবার যে ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে রোববার রাতে পাথেইনে গুলিবিদ্ধ হওয়া তিনজন রয়েছে।

এর আগে দ্য ইরাবতী গত রোববার রাতে ইয়াঙ্গুনের নয়টি টাউনশিপ- হ্লেইং থারইয়ার, শেপইথার, নর্থ ওক্কালাপা, সাউথ দাগোন, ইনসেইন, হ্লেইং, থিনগানগুন, কিমিনদায়েং এবং নর্থ ডাগোন এবং বাগো অঞ্চল, কাচিন রাজ্যের হপাকান্ত এবং মান্দালায় অঞ্চলে ৩৯ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করে।

হ্লেইং থারইয়ার টাউনশিপের একটি হাসপাতাল জানিয়েছে, সোমবার তাদের কাছে ৩৭ জনের মৃতদেহ এসেছে। এসময় প্রায় ৪০ জনকে আহতাবস্থায় ভর্তি করা হয়। ইয়াঙ্গুনের আরেকটি হাসপাতাল জানিয়েছে, তাদের কাছে সাতজনের মৃতদেহ এসেছে। আর ৫৬ জন আহত ব্যক্তিকে ভর্তি করা হয়েছে।

লাইংথাইয়া শিল্প এলাকায় চীনের অর্থায়নে পরিচালিত কয়েকটি কারখানায় রোববার আগুন দেয়া হয়। এরপরই বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয় নিরাপত্তা বাহিনী। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সেখানে প্রায় দুই ডজন মানুষের মৃত্যু হয়। যদিও কেউ কারখানা পোড়ানোর দায় স্বীকার করেনি।

রাজবন্দিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানিয়েছে, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইয়াঙ্গুনের হ্লাইং থারিয়ার এলাকায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেটেটের পাশাপাশি সরাসরি তাজা গুলি ছোঁড়ে। এতে অন্তত ২২ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। তাদের কারো কারো অবস্থা গুরুতর। নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলেই আশংকা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে বিক্ষোভকারীরা এ দিন লাঠি ও ছুরি নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন।

চীনের অনেকগুলো কারখানা রয়েছে হ্লাইং থারিয়ার এলাকায়। বিক্ষোভকারীরা সেগুলোতে হামলা চালাতে পারেন আশঙ্কায় সেখানে বেইজিংয়ের অনুরোধে সামরিক আইন জারি করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বেইজিংয়ের তরফে খবরে বলা হয়, মানুষজন লোহার রড, কুড়াল ও পেট্রোল নিয়ে হামলা চালিয়েছে দশটি কারখানায়। বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক আহত হয়েছে। এছাড়া চীনা একটি রেস্তোরাঁতেও হামলা হয়েছে। চীন মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে বলে মনে করে বিক্ষোভকারীরা। বেইজিং সরকার অবশ্য এ ধরনের গুঞ্জন অস্বীকার করেছে।

রোববার হ্লাইং থারিয়ার এলাকায় বিক্ষোভের ভিডিওতে নিরাপত্তা বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার সময় বিক্ষোভকারীদের অনেককে ঘরে বানানো ঢাল ধরে থাকতে ও হেলমেট পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে। সেখানে কালো ধোঁয়ার আস্তরণও দেখা গেছে। ওই এলাকার দুটি কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

চিকিৎসাকর্মীদের বরাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তাবাহিনী রাবার বুলেট ও তাজা গুলি ছোড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক বলেন, এটা ভয়ঙ্কর। আমি চোখের সামনে গুলি করে বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে দেখেছি। এমন নৃশংস দৃশ্য জীবনে ভুলতে পারব না।

এক চিকিৎসাকর্মী বলেন, আমি চিকিৎসার দেয়ার সময় চোখের সামনেই তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আমি আরও দুজনকে হাসপাতালে পাঠাচ্ছিলাম। এই মুহূর্তে এটুকুই আমি বলতে পারি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সারা দিন গুলির শব্দ শোনা গেছে। রাস্তায় সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া ট্রাকের টহল চলছে।

এক পুলিশ সদস্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে লিখেছেন, পুলিশ ভারি অস্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। পরে মুছে ফেলা টিকটক পোস্টে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, হ্লাইং থারিয়ারে কোনও দয়া দেখাবো না।

গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে মিয়ানমারে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়। অভ্যুত্থানের পর গ্রেফতার করা হয়েছে সু চিসহ তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) শীর্ষ নেতাদের। সেনাবাহিনীর অভিযোগ,গত নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি করে জয় পেয়েছে এনএলডি। তবে এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। দেশটিতে বর্তমানে জান্তা শাসকদের বিরুদ্ধে টানা বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। তবে তাতে দমছেন না আন্দোলনকারীরা।