শুধু আইন করেই নয়, ধর্ষণ বন্ধে ‘বিচার নিশ্চিত’ প্রয়োজন

দেশজুড়ে একের পর এক ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে তুমুল আন্দোলনের মুখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে সম্প্রতি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। আগে কেবল সংঘবদ্ধ ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকলেও আইনের সংশোধনীতে ধর্ষণেরও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়।

কিন্তু আইনের এমন সংশোধনীর পরও বন্ধ হচ্ছে না ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা। এক্ষেত্রে অতীতে বিচারহীনতার নজিরকেই দায়ী করছেন আইনবিদরা। তারা বলছেন, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না করলে আইন সংশোধন করেও কোনো ফায়দা হবে না। বিচার নিশ্চিত না করে যত কঠোর আইন-ই হোক, ফলপ্রসূ হবে না।

আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণ-নারী নির্যাতন বন্ধে সমাজে এই মেসেজ বা বার্তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে, অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে। সেজন্য দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন, ঘটনার সঠিক অনুসন্ধান ও তদন্ত এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা জরুরি।

আন্দোলনের মুখে আইন সংশোধন

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনার ধারাবাহিকতায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে এক গৃহবধূকে স্বামীর সামনে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী। ওই ঘটনার কদিন পর ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে একদল যুবকের পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

পরে ৯ অক্টোবর বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে ‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নারী নির্যাতন বিশেষ করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি জানানো হয়। শাহবাগ থেকে সেই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ এর কয়েকটি ধারা সংশোধন করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো—ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আগের আইনে ধর্ষণের শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

গত ১৪ অক্টোবর এ সংশোধিত আইন অধ্যাদেশ আকারে জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ।

শাস্তি কঠোর হওয়ার পরও থামছে না পাশবিকতা-বর্বরতা

কিন্তু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে অধ্যাদেশ জারির পরও গত ১৭ অক্টোবর বান্দরবানে এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে পরদিন ১৮ অক্টোবর বান্দরবান সদর থানায় মামলা হয়। এরপর ১৮ অক্টোবর ফেনীতে এক আদিবাসী তরুণীকে দুই দফা ধর্ষণ, ১৯ অক্টোবর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় নাচের শিক্ষিকাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ২১ অক্টোবর রাতে গাজীপুরের কাশিমপুরের কারখানা থেকে বাসায় ফেরার পথে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এক পোশাক শ্রমিককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাসহ আরও কিছু ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে।

আইন কঠোর করার পরও এই পাশবিকতা বন্ধ না হওয়ার বিষয়ে আইনজীবীরা বলছেন, বিভিন্ন সমস্যা চোখে পড়লে আইন সংশোধনের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। সেই আন্দোলনের চাপে আইন সংশোধনও হচ্ছে। কিন্তু যে কারণে আইন সংশোধন হচ্ছে, সরকারি সিদ্ধান্ত আসছে, সে সমস্যাই থেকে যাচ্ছে। এটার মূল কোথায়, তা চিহ্নিত করতে হবে। ধর্ষণ বন্ধে সরকারের দায়িত্ব দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের বিচার কতদিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে, সেটা আইনে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।

আইনজীবীরা যা বলছেন

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সাজা বাড়ালেই ধর্ষণ কমবে, বিষয়টি এমন নয়। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সঠিক তদন্তের অভাবে অনেক সময় প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ধর্ষণ মামলা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ—অপরাধীরা রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাবশালীদের আশীর্বাদ নিয়ে চলে। তারা (ধর্ষক) মনে করে, তাদের সাজা হবে না। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের লোকজনও প্রভাবিত হন। এ কারণে অনেক সময় সঠিক তদন্ত হয় না। তাই কেবল আইন করলেই হবে না, সেটা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ দিতে হবে।’

তবে ধর্ষণ মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করায় শঙ্কার কথাও বলেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘একটা আশঙ্কা আমরা করছি, সেটা হয়তো ভিকটিমকে মেরে ফেলার শঙ্কা বাড়তে পারে। ভিকটিমকে বাঁচিয়ে রাখলে যেহেতু অপরাধীকে চিহ্নিত করে ফেলতে পারবে, তখন ভিকটিমকে মেরে ফেলে চিহ্নিত করার আর সুযোগ রাখতে চাইবে না অপরাধী। তাছাড়া ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ, যেটা জনসম্মুখে হওয়ার মতো নয়। যেহেতু এটা নির্জনে লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটানো হয়ে থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়তো চাক্ষুস সাক্ষীও থাকে না, ফলে মেরে ফেলার ঘটনা হয়তো বাড়তেও পারে।’

এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে, এটাকে আমি ইতিবাচক মনে করি। যখন কোনো আইন হয়, তখন এর একটা উদ্দেশ্য থাকে। সেটাকে বাস্তবায়নের সুযোগ দিতে হবে। এখন দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের বিচার কতদিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে, সেটা আইনে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। আর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করতে না পারলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’

তিনি বলেন, ‘আইন সংশোধন করে তখনই লাভ হবে যখন ওই আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ হবে। যেমন ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন সাজার পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। এখন যদি ধর্ষণের কয়েকটি মামলার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করে আসামির মৃত্যুদণ্ডের সাজা কার্যকর করা যায়, তবে দেখবেন এর প্রভাব সমাজে পড়েছে। অর্থাৎ আইনের কঠোর প্রয়োগ হলে অপরাধীরা কিছুটা হলেও ভয় পাবে। ঠিক একইভাবে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও আইনের কঠোর প্রয়োগ হতে হবে। আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদি পক্ষপাতিত্ব করা হয়, তখন যত কঠিন আইন-ই করুন না কেন তাতে লাভ হবে না।’

বিশিষ্ট এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘শাস্তি নিশ্চিতে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করতে হবে। মাত্র ১৮০০ বিচারক দিয়ে ১৮ কোটি মানুষের বিচারসেবা দেয়া সম্ভব নয়। সময়মতো সাক্ষী হাজির করা এবং তদন্তের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।’

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ফৌজিয়া করিম মনে করেন, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করায় সমাজে এর একটা প্রভাব পড়বে। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা আশঙ্কাও আছে তার। বলেন, এমনিতেই ধর্ষণের সাক্ষী পাওয়া যায় না, শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় এখন সাক্ষীদের মধ্যে আরও ভীতি তৈরি করবে। কারণ ধর্ষকরা বেশিরভাগই প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক কর্মী। তাই ভিকটিমের সুরক্ষা এবং সাক্ষীর সুরক্ষা আইন করা খুবই প্রয়োজন। গত ১৭ বছরে এ আইনটি না হওয়া দুঃখজনক।’

তবে ধর্ষণ রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করাই সমাধান নয় বলে মনে করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড করলে যদি অপরাধ কমতো তাহলে অন্যান্য যে অপরাধ বা হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, সেগুলো কি কমছে? পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন আছে, সেটা কি কমেছে? কমেনি। সুতরাং আইন করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, যে আইন আছে সেটা যথাযথভাবে বাস্তবায়নই মুখ্য উদ্দেশ্য।’

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আইনের যে মেসেজ জনগণের কাছে থাকা দরকার যে—অপরাধ করলে সাজা হবেই নিশ্চিত, এ মেসেজ বর্তমানে নেই। অনেকগুলো কারণে নেই। এর মধ্যে অন্যতম আইনের শাসনের দুর্বলতা। প্রশাসনের যারা আইন প্রয়োগ করবেন, সেখানে তাদের স্বাধীনতাটাও অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। কারণ যারা পলিটিক্যালি পাওয়ারফুল বা অর্থশালী, বিত্তশালী—তাদের কথা মতো অনেক জায়গায় প্রশাসনকে চলতে হয়। অতএব সেসব স্থানে যখন অপরাধ হয়, অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এই আইনের দুর্বলতাটা যদি কাটাতে না পারেন, তাহলে মৃত্যুদণ্ডের আইন করলেও হবে না। মামলা হবে, দীর্ঘদিন তদন্ত হবে না, পরে সাক্ষ্য-প্রমাণও হবে না।’

এ মানবাধিকার আইনজীবী বলেন, ‘আরও একটা জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাজাটা দ্রুত নিশ্চিত করা। বছরের পর বছর শত শত লোক কারাগারে আছে। তাদের মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে, কিন্তু রায় চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হয়নি। এই দুর্বলতাও দূর করতে হবে। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আসা আপিলের মামলাগুলোতে পেপারবুক তৈরি করতে হয়। পেপারবুক তৈরি করতে হলে প্রেস দরকার। বিচারকের সংখ্যা কম, বিচারককে যারা সহযোগিতা করবেন, তেমন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাও কম। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।’

মনজিল মোরসেদের মতে, ‘আলোচিত ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশের পর হয়তো একটা বিচার করে ফেলল, কিন্তু চূড়ান্তভাবে শেষ হবে না। যদি অন্যান্য স্থানগুলো সেই ব্যবস্থা না করে। যেখানে বিচারের ক্ষেত্রে দুর্বলতা সেখানে এবং আইনের শাসনের দুর্বলতা যেখানে, সেখানে সরকারের পদক্ষেপ লাগবে। আল্টিমেটলি সরকার-প্রশাসনের ভূমিকার ওপরই নির্ভর করছে, অপরাধের বিচার শেষ করে শাস্তি নিশ্চিত করা।’