সাংগঠনিক স্থবিরতা বিএনপিতে

রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। দলটির তিন বছর মেয়াদের জাতীয় সম্মেলন আট বছর পার হয়েছে। কবে সম্মেলন হবে কেউ বলতে পারে না। প্রায় ৬০০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩০টির মতো পদ শূন্য।

৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অর্ধ শতাধিক কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। অধিকাংশ জেলায় আংশিক আহ্বায়ক কমিটি হলেও দীর্ঘদিনেও সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। গত আট বছরে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা হয়েছে মাত্র একবার। ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই সভার পর কেটে গেছে পাঁচ বছর। আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল শক্তি দুটি সহযোগী ও নয়টি অঙ্গসংগঠন। এগুলোর সাংগঠনিক অবস্থাও বেহাল।

চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনগুলোয় তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খল অবস্থা। সব মিলিয়ে দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে দায়সারা পালিত হচ্ছে দলটির আন্দোলন কর্মসূচি। জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ আমাদের বেকায়দায় ফেলেছে। আমাদের নেতাদের মিথ্যা মামলায় আটক রাখছে, সাজা দিচ্ছে।

দলের চেয়ারপারসন জেলখানায় আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে, এ অবস্থায়ও আমরা আন্দোলন করে চলেছি। আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে বেশ কিছু জেলা কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ। দলের জাতীয় সম্মেলনও হয়েছে কয়েক বছর হলো। তিনি বলেন, দলের হাইকমান্ড জাতীয় সম্মেলন, মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা কমিটি এবং অঙ্গসংগঠনগুলো নিয়ে নিশ্চয় চিন্তা করছেন।

আশা করছি রোজার পর পর্যায়ক্রমে এসব জটিলতা কেটে যাবে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলনও জোরদার হবে। জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন কওে বিএনপি। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতা মারা গেছেন। নিষ্ক্রিয় আছেন বা বাদ পড়েছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩০টির মতো পদ বর্তমানে শূন্য।

কেন্দ্রের পাশাপাশি জেলা-উপজেলাসহ সব স্তরেই স্থবির হয়ে আছে বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনে কাটছে দীর্ঘ সময়। এ অবস্থায় সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন কিংবা শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দিতে পারছেন না দলটির নীতিনির্ধারকরা।

তাদের দাবি, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতনসহ ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সংগঠন গোছানোর কাজটি হয়ে উঠছে না। জানা যায়, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুরোদমে দল পুনর্গঠন কাজ শুরু করেছিল বিএনপি। সেই সময় মূল দল ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি হালনাগাদের উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। ওই উদ্যোগের পর মাত্র ২০টির মতো জেলা কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সাংগঠনিক জেলার সংখ্যা ৮২।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে মাত্র ১০টিতে মূল কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি আবার আংশিক। ৫২টি জেলা কমিটি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। বাকিগুলোর হালনাগাদ তথ্য নেই। সব মিলিয়ে ৫০টির বেশি জেলা কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। মাঝে-মধ্যে কমিটি করতে গেলে বিশেষ ‘সিন্ডিকেট’ তাতে হস্তক্ষেপ করায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

দীর্ঘ সময়েও জেলা শাখা ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন না হওয়ায় মাঠপর্যায়ের অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা-কর্মী দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। অনেকে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন। এসব কারণে অনেক জেলায় নামকাওয়াস্তে পালিত হয় আন্দোলন কর্মসূচি। জানা গেছে, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ পদের মধ্যে বর্তমানে শূন্য আছে পাঁচটি।

এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যানের ১৩টি, উপদেষ্টা ১৫টি, সম্পাদক ও সহসম্পাদকসহ প্রায় শতাধিক পদ শূন্য। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল গঠনতান্ত্রিকভাবে বিএনপির সহযোগী সংগঠন। আর অঙ্গসংগঠন হিসেবে রয়েছে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, ওলামা দল, জাসাস ও মহিলা দল। এসব সংগঠনের মধ্যে কয়েকটির পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকলেও বেশির ভাগের মেয়াদ নেই। ২০১৪ সালের পর থেকে কয়েকবার ঢাকা মহানগরের নেতৃত্বে রদবদল এনেও সুফল পায়নি বিএনপি।

এ কারণে ২০১৭ সালে ঢাকা মহানগরকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করে পৃথক দুটি কমিটি করা হয়। তাতেও আশানুরূপ ফল আসেনি। সর্বশেষ ২০২১ সালের আগস্টে ডাকসুর সাবেক ভিপি আমান উল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হককে সদস্য সচিব করে ঢাকা উত্তর এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামকে আহ্বায়ক ও রফিকুল ইসলাম মজনুকে সদস্য সচিব করে দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এরই মধ্যে ঢাকা উত্তরের ৭১টি ওয়ার্ডের সব এবং দক্ষিণের ৮০টির মধ্যে ৫৬টিতে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। নেতা-কর্মীদের অভিমত, দুই মহানগরের বর্তমান নেতারা নানা তৎপরতায় রাজধানীতে আন্দোলন জমানোর চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেননি। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে।