সাতক্ষীরা ঘুরে গেলেন মশা বিশেষজ্ঞ ড. কবিরুল বাশার, দিলেন মশা তাড়ানোর পরামর্শ

সাতক্ষীরা ঘুরে গেলেন মশা বিশেষজ্ঞ ড. কবিরুল বাশার, দিলেন মশা তাড়ানোর পরামর্শ।

মশার তীব্র যন্ত্রণায় যখন সাতক্ষীরাবাসী অতীষ্ঠ তখন সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামালের আমন্ত্রণে সম্প্রতি অনেকটা নীরবেই মশা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিতে সাতক্ষীরা ঘুরে গেলেন বাংলাদেশের অন্যতম মশা বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ -এর কীটতত্ত্ব বিষয়ক পরামর্শক ড. কবিরুল বাশার।
তাঁকে সাতক্ষীরায় সার্বক্ষণিক সহায়তা করেন সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুব্রত ঘোষ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মশা গবেষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জরিপ করে দেখা গেছে, বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন মশার ঘনত্ব তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মার্চের পর থেকে আরও বাড়তে থাকবে। অথচ মশার প্রজননস্থলগুলো পরিষ্কার করে এ উপদ্রব কমিয়ে আনা সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘এক মাস আগেই একটা প্রেডিকশন দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলেছিলাম, মার্চ মাস নাগাদ মশার পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং বাড়তেই থাকবে। এখন মশার অবস্থা খুবই খারাপ। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত, বর্তমান সময়ে মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এগুলো কিউলেক্স মশা।’

ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘মশার রয়েছে দুটি স্টেজ। একটি লার্ভার স্টেজ, যা পানিতে থাকে। অন্যটি পূর্ণাঙ্গ, যা উড়ন্ত মশা। গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা এসব মশার ডেল সিটি ইনডেক্স বের করি। লার্ভার ডেল সিটি ইনডেক্সের ক্ষেত্রে ডিভাইস দিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে পানি নিয়ে এর সংখ্যা হিসাব করি। গড় বের করে দেখি, প্রতি ডিপে মশার সংখ্যা কত। সেখানে আমরা এপ্রিলের পর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পেয়েছি গড়ে ১৫ থেকে ২০টি মশা। এখন গড়ে প্রতি ডিপে পাচ্ছি ৬০টি। প্রায় চারগুণ বেশি। অর্থাৎ এ মুহূর্তে চারগুণ বেশি মশা রয়েছে বছরের অন্য সময়ের তুলনায়।’

অন্য পদ্ধতিতে পরিমাপের বিষয়ে এই গবেষক বলেন, ‘এডাল্ট ঘনত্বের ক্ষেত্রে একজন মানুষকে আমরা কোনো একটি স্থানে বসাই। এরপর নিচ থেকে হাটু এবং হাত পর্যন্ত খুলে দেই। তখন দেখি বাইট রেট কত হলো, সেটি গড় করি। এটাকে বলে হিউম্যান ল্যান্ডিং ক্যাচ। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় মানুষের ওপর কতটি মশা ল্যান্ড করে। এটিও বৈজ্ঞানিক উপায়ে মশার ঘনত্ব পরিমাপক। এই পরীক্ষায়ও দেখা গেছে, অন্য সময়ের চেয়ে মশার পরিমাণ চারগুণ বেড়েছে।’

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘দ্রুত এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে ওয়ার্ডগুলোতে জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে ক্রাশ প্রোগাম চালানো দরকার। যেসব স্থানে পানি আছে, মশার জন্ম হতে পারে এসব স্থানে একসঙ্গে লার্ভিসাইডিং করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে ওয়ার্ডের একটু জায়গাও যেন বাদ না যায়। একদিন বা দুদিনের মধ্যে এ কাজটি করতে হবে। এর মধ্যেই করতে হবে এডাল্টিসাইডিংও। অর্থাৎ একসঙ্গে ক্রাশ করে দিতে হবে। তা হলেই মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে।’

তিনি বলেন, ‘কেবল প্রশাসন নয়, এ কাজে নগরবাসীকেও এগিয়ে আসতে হবে। মশক নিধনে সহায়তা করতে হবে।’

আমাদের চারপাশে প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে মশা প্রতিরোধের ওষুধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিমে বিদ্যমান অ্যালকালাইড মশার ‘যম’। অ্যালকালাইডের কারণে মশা দূরে সরে যায়। ভেষজ গাছ নিমের পাতা এবং এর তেল মশার আক্রমণ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে। রসায়নবিদ, প্রাণিবিদ, উদ্ভিদবিদ এবং কৃষি তথ্য সার্ভিসের মাধ্যমে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, নিম ফুলের মধু অন্যান্য ফুলের মধুর তুলনায় বেশি পুষ্টিকর ও ঔষধি গুণসম্পন্ন; নিম মাটির ক্ষয় ও মরুময়তা রোধ করে। কৃষি জমির পাশে (আইলে) নিম গাছ লাগালে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। নিম থেকে তৈরি ওষুধ, প্রসাধনী, জৈবসার ও কীট বিতাড়ক বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। নিমের পাতা, ছাল-বাকল, বীজ ও কাঠসহ সব অংশই রফতানিযোগ্য।

রাসায়নিক উপাদান হিসেবে নিমের ছাল, ফুল, ফল, বীজে ও তেলে বিভিন্ন ধরনের তিক্ত উপাদান, যেমন—স্যাপোনিন, অ্যালকালয়েড নিমবিডিন, নিম্বন, নিম্বিনিন, নিম্বডল, ট্রাইটারপেনয়েড, সালনিন, এজাডিরাকটিন, জৈব অ্যাসিড, মেলিয়ানোন, নিম্বোলাইড, কুয়ারসেটিন ও গ্লাইকোসাইড, ট্যানিন, মারগোসিন, এজমডারিন এসব থাকে।

কীটতত্ত্ববিদদের মতে, নিমে ৫০টির বেশি অ্যালকালয়েড থাকে। এদের মধ্যে এজাডিরাকটিন ও নিমবিন মশা দমন করে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘নিম গাছে অ্যালকালয়েড থাকে, যার কারণে মশা দূরে সরে যায়। শুধু মশা নয়, নানা ধরনের পোকামাকড়ও নিমের কাছে ভিড়তে পারে না। বিছানায় ছারপোকা হলে সেখানে নিম পাতা দিয়ে রাখলে ছারপোকা দূরে সরে যায়। আবার নিমের তেল গায়ে মাখলেও মশার ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়।’

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুব্রত ঘোষ বলেন, ‘নিম গাছের পাতা পানি দিয়ে হালকা পিষে যে রস বের হবে, ওটা পায়ের পাতায় ও হাতে যদি দেওয়া হয়, তাহলে মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আরেকটা হচ্ছে, নিমের পাতা পানিতে সিদ্ধ করার পর যেটা বের হবে, ওই পানি এবং নিমের তেল খানিকটা মিশিয়ে গায়ে মাখলে মশায় কামড়াবে না।

তিনি আরও বলেন, ‘নিমের তেল হাতে পায়ে দিলে কোনও ক্ষতি নেই। যদি মুখের ভেতরে কোনও কারণে চলে যায়, তাতেও কোনও ক্ষতি নেই। বাচ্চাদের জন্য এটা খুব উপকারী। আমরা একটি জারের মধ্যে নিমের তেল রেখে একটি মশা রেখেছিলাম সেখানে। মশাটি কিন্তু মারা গিয়েছিল। নিমের একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে—মশা তাড়ানো এবং একই সময়ে মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার বিশেষ উপায়। আমি নিজে আমার ছেলের হাত ও পায়ে নিমের তেল লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। চমৎকার কাজ হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই নিম গাছের শুকনা পাতা মশার কয়েলের মতো ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, অনেক কোম্পানির মশার কয়েলেও নিমের ব্যবহার আছে। নিম গাছের পাতায় কিছু উপাদান আছে, যেটাকে মশা সহ্য করতে পারে না। নিমের আরও ভেষজ গুণ আছে। চর্মরোগের ক্ষেত্রেও এটা উপকারী।’

অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার সাতক্ষীরায় আমন্ত্রণের জন্য সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল এবং সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা. সুব্রত ঘোষকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, শুধু সরকার বা প্রশাসন নয়, সকলে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করলেই কেবল মশা সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব হবে।