সাত বছরেও মেলেনি ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার

আজ ৭ জানুয়ারি, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী হত্যা ট্র্যাজেডির ৭ বছর পূর্তি। এখনো মেলেনি এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুয়াশাছন্ন শীতের এই দিনে ভারতের আসাম রাজ্যের বনগাইগাঁও এলাকা থেকে পিতা নুর ইসলামসহ কিশোরী নিজ বাড়ি বাংলাদেশে আসার সময় ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর হাজিটারী সীমান্তের ৯৪৭/৩এস আন্তর্জাতিক পিলারের পাশে ভারতীয় খেতাবেরকুটি সীমান্তে চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফ তাকে পাশবিক নির্যাতন ও পরে পাখি শিকারের মত গুলি করে হত্যা করে ফেলানীকে।

এ সময় বিএসএফ হায়েনারা ফেলানীকে হত্যা করার পরও ক্ষান্ত হয়নি। তারা ফেলানীর মৃতদেহকে দীর্ঘ সময় কাটা তারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে।

বিশ্ব আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ভারতের উচ্চ আদালতে গড়ালেও এখনও ন্যায় বিচার পায়নি ফেলানীর পরিবার। হত্যাকারী অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে দু’দফায় বেকুসর খালাস দেয় বিএসএফের বিশেষ আদালত। ন্যায় বিচারের আশায় ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে দুটি রিট পিটিশন দাখিল করলেও সেটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।

ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম জানান, বিএসএফের বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার ন্যায় বিচার না পেয়ে ২০১৫ সালে ভারতের আইনজীবী অপর্নাভাট ও মানবাধিকার সংগঠন মাসুমের সহায়তায় ভারতের উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করি। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রিট গ্রহণ করে আগামী ১৮ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করেছে। আমি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কাছে আমার মেয়ে ফেলানী হত্যার ন্যায় বিচার আশা করছি।

ফেলানীর মা জাহানারা বেগম জানান, আমার মেয়েকে (ফেলানী) বিএসএফ পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে। কিন্তু এখনো আমি আমার মেয়ে ফেলানী হত্যার বিচার পেলাম না। ফেলানীর আত্মার শান্তির জন্য ভারতের সুপ্রীম কোর্টের কাছে ফেলানীর হত্যাকারী বিএসএফের ফাঁসি দাবি করেন তাঁর মা।

ফেলানীর বাবা আইন সহায়তাকারী কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন সাংবাদিকদের জানান, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ফেলানীর বাবার দুটি রিট গ্রহণ করে একাধিকবার শুনানির দিন পিছালেও আগামী ১৮ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য্য করেছে। আমরা আশা করছি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ফেলানী হত্যা মামলায় একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিবে সেটা উভয় রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গল হবে।

ফেলানী হত্যা ও তার বাবার ভারত যাওয়ার কারণ:
ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম জানান, বাবা হাফেজ আলীর মৃত্যুর পর তার বয়স যখন ৯/১০ বছর তখন অভাবের তাড়নায় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর উপজেলার দক্ষিণ রামখানা কলোনীটারী থেকে বিধবা মা আলীজনের সাথে তিনি এবং তার ছোট ভাই আব্দুল খলিল ভারতের জলপাইগুড়িতে কাজের খোঁজে যায়। ওই সময় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। জলপাইগুড়িতে তারা বেশ কিছুদিন থাকে। এর মধ্যে মা আলীজন বিবির মৃত্যু হলে তাকে জলপাইগুড়িতে কবর দেয়া হয়। মায়ের মৃত্যুর পর অভাব তাদের মাঝে গ্রাস করলে দুই ভাই দুইদিকে কাজের সন্ধানে বের হয়। বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে গিয়ে ভারতের আলীপুরে ফেলানীর মা জাহানারা বেগমের সাথে পরিচয় ঘটে।

জাহানারা একই ভাবে অভাবের তাড়নায় তার দাদীর সঙ্গে আলীপুরে থাকত। নুর ইসলামের গ্রামের বাড়ির পার্শ্ববর্তী গ্রাম দক্ষিণ রামখানা বানারভিটার বাসিন্দা জাহানারা হওয়ায় প্রতিবেশী সম্পর্কে একপর্যায় নুরইসলাম ও জাহানারা বেগমের বিয়ে হয়। দুই স্বামী-স্ত্রীর সংসারে দুই মেয়ে সন্তান জন্ম নিলেও সন্তান দুটি জন্মের কিছুদিন পর মারা যায়।

দুই সন্তানের মৃত্যুর পর স্বামী-স্ত্রী দুজনে আলীপুর ছেড়ে আসামের গোয়ালপাড়া জেলার নিউ বংগাইগাও ভাওলা গুড়িতে চলে যান। সেখানে জন্ম হয় ফেলানীর। দুই মেয়ে সন্তানের মৃত্যুর মত ফেলানীরও মৃত্যু হতে পারে এই আশঙ্কায় তার নাম রাখা হয় ফেলানী।

পরে ফেলানীসহ আরো ৫ সন্তানের জন্ম হয়। এরা হলো- মালেকা খাতুন, জাহানউদ্দিন, আরফান আলী, আক্কাস আলী, কাজলী খাতুন। নিউ বংগাইগাও ভাওলা গুড়িতে একটি মুদির দোকান দিয়ে তাদের ৩ মেয়ে ৩ ছেলে ও দুই স্বামী স্ত্রী মিলে পরিবারের ৮ সদস্যের সুখের সংসার চলছিল।

অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা স্বচ্ছল হলে দেশে ফিরে আসবে এই আশায় তারা আসামের নাগরিকত্বের সুযোগ পেলেও তা গ্রহণ করেনি। নুর ইসলাম দেশে আসবে বলে বাংলাদেশের ভোটার হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করে সে। ভোটের সময় এলে আসাম থেকে এসে এখানকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ভোট প্রয়োগ করতেন তিনি।

এর মধ্যে মেয়ে ফেলানী বড় হয়ে উঠলে তাকে বাংলাদেশে বিয়ে দিবে এই পরিকল্পনা নেয় তারা। শ্বাশুড়ি হাজেরা বিবির সম্মতিক্রমে ছোট্টবেলায় কথা দেয়া স্ত্রী জাহানারা বেগমের আপন বড় বোন লালমনিরহাট জেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের চরকুলাঘাট গ্রামের ইদ্রিস আলী ও তার স্ত্রী আনজিনা বেগমের বড় পুত্র আমজাদ হোসেনের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়। নুর ইসলাম আসাম থেকে এসে আমজাদ হোসেনের মায়ের সঙ্গে ২০১১ ইং সালের ৯ জানুয়ারি বিয়ের দিন ধার্য অনুযায়ী মেয়ে ফেলানীকে নিয়ে ৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টায় নুর ইসলাম আসাম থেকে রওনা দেয় বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।

ফেলানীর মা জাহানারা বেগম মেয়েকে নিজ হাতে সাজিয়ে দেন। পড়িয়ে দেন হাত, গলা, কান, নাকে ও পায়ে স্বর্ণ ও রুপার অলংকার। হবু জামাই আমজাদ হোসেনের জন্য দুইটি আংটি, একটি চেইনসহ মেয়ের হাত খরচের নগদ ১৯০০/- (ভারতীয়) টাকা সাথে দেন। ফেলানীও তার হবু জীবন সঙ্গীর জন্য একটি রুমাল, কিছু উপহার সামগ্রী নিয়ে বাবার সাথে আসে।

দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে তারা রাত ৮টার দিকে আসাম থেকে চৌধুরীহাট বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালে ভারতীয় চৌধুরীহাট খেতাবের কুটি সীমান্তবর্তী গ্রামের আবুল হোসেন এর ছেলে দালাল মোশারফ হোসেন (৩৮) ও দালাল বুর্জত আলী (৩০) সহ ৩/৪জন দালাল তাদের পিছু নেয়।

দালালরা তাদেরকে কাঁটাতারের বেড়া পার করে দেয়ার জন্য ৩ হাজার টাকা চুক্তি করে। দালাল মোশারফকে চুক্তির টাকা দেয়ার সময় ফেলানীর বাবা দালালের কাছে প্রতিশ্রুতি নেয় তার মেয়ের যেন কোন ক্ষতি না হয়। তার কথা মতো দালাল মোশারফ ক্ষতি না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে আশ্বস্ত হন ফেলানীর বাবা।

পরে রাত ৯টার দিকে দালাল মোশারফ হোসেন ফেলানী ও বাবাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে কাটাতার বেড়া পার করে দেয়ার অজুহাতে দালাল মোশারফ ফেলানী ও তার বাবাকে আরো ৩/৪টি বাড়িতে আনা নেওয়া করে।
রাত ৯টা থেকে গভীর রাত ৩/৪টা পর্যন্ত এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে টানা হেঁচড়া করায় ফেলানী একটু ঘুমাতে চেষ্টা করেও তা পায়নি। নির্ঘুম রাত কাটানো ও টানা হেঁচড়ায় ক্লান্ত ফেলানী ও তার বাবাকে ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে ফজরের আযানের সময় ফুলবাড়ীর অনন্তপুর হাজীটারী সীমান্তের আন্তর্জাতিক পিলার ৯৪৭/৩এস এর পাশে ভারতের অভ্যন্তরের চৌধুরীহাট খেতাবের কুটি এলাকায় নিয়ে আসে দালালরা।

ওই এলাকায় কাঁটাতারের ৩ স্তরের বেড়া পার হতে বাঁশের তৈরি ৩টি মই কাঁটাতারের বেড়ায় লাগানো হয়। সেই মই বেয়ে প্রথমে নুর ইসলাম পরে মেয়ে ফেলানী পার হওয়ার সময় চৌধুরী হাট ক্যাম্পের বিএসএফ তাদের পিছু নেয়।
মই বেয়ে কাঁটাতার পার হওয়ার সময় ২/৩জন বিএসএফকে তিনি মইয়ের উপরে উঠতে দেখেন। একসময় একটি গুলির শব্দ হলে নুর ইসলাম ভয়ে পড়ে যান কাঁটাতারের বাহিরে। তখন মেয়ে ফেলানী ছিল কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে। কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ভারত ভূখন্ডে পড়ে যাওয়া নুর ইসলাম তরিঘড়ি উঠে ফেলানীকে তারাতারি কাটা তারের বেড়া পার হয়ে আসার জন্য বলেন। কিন্তু কিভাবে ফেলানী মারা গেল তা তিনি ঝুঝতে পারেননি।

নুর ইসলাম বলেন, কাঁটাতারের মাঝখানে মইয়ের উপর দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় ফেলানীকে গুলি করলে সে কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে পড়ে থাকতো কিন্তু কিভাবে কাটাতার বেড়ার শেষ প্রান্তে ফেলানীর লাশ ঝুলে থাকলো এটা তাকে প্রশ্নের সৃষ্টি করে।
নুর ইসলাম জানান, একটি গুলির শব্দ শুনলেও তিনি আরো একটি কম আওয়াজের গুলি হয়েছে বলে পরে মানুষের কাছে শুনেছেন। এতে ধারণা হয় ফেলানীর বাবাকে ভয় দেখানোর জন্য একটি ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছিল। এতে ধারণা করা হয় ফেলানীকে পাশবিকভাবে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে তার লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে বিএসএফ।

৭ জানুয়ারির ভোর থেকে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে ছিল ফেলানীর লাশ। ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম মেয়ের হত্যার কথা শুনে সঙ্গাহীন হন। সাড়ে ১০টার দিকে ফেলানীর মৃত্যুর খবর পায় তার পরিবার। ওই দিন কুড়িগ্রাম বিজিবির ২৭ ব্যাটালিয়নের কাশিপুর কোম্পানির পক্ষ থেকে লাশ ফেরত চেয়ে বিএসএফকে পত্র দেয়া হলে ফেলানীর লাশ পোস্ট মর্টেম শেষে পরের দিন ৮ জানুয়ারি বেলা ১১টায় ওই সীমান্তে বিজিবি কাশিপুর কোম্পানি ও বিএসএফ চৌধুরীহাট কোম্পানির পর্যায় পতাকা বৈঠকে বিজিবিকে ফেলানীর লাশ ফেরত দেয় বিএসএফ।

পরে বাংলাদেশে ফেলানীর পোস্ট মর্টেম শেষে ৯ জানুয়ারি রাতে তার পরিবারের কাছে ফুলবাড়ী থানার পুলিশ লাশ হস্তান্তর করলে ওই রাতেই কলোনীটারী গ্রামে ফেলানীকে দাফন করা হয়। ফেলানী হত্যার এই নির্মম ঝুলন্ত ছবি ও খবর দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় প্রকাশ হলে দেশে-বিদেশে শুরু হয় বিএসএফের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ। কাটা তারের বেড়ায় ঝুলছে না ফেলানী, ঝুলছে বাংলাদেশ র্শীষক প্রতিবাদী স্লোগানে ও ফেলানীর ঝুলন্ত ছবি গোটা জাতিকে হতভম্ভ করে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের পক্ষে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধের প্রতিবাদে বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হলে টনক নড়ে বাংলাদেশ সরকারের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফেলানী হত্যার কড়া প্রতিবাদ জানানো হয় ভারতকে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও মানবাধিকার সংস্থার কর্মকর্তারা ছুটে আসে ফেলানীর নিভৃত পল্লীতে।

বিজিবির দাবির মুখে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারের বিএসএফের বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার কাজ শুরু হয়। ফেলানীর বাবা দু’দফা বিএসএফের আদালতে স্বাক্ষী দিয়ে আসলেও ওই বছর ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত।

রায় পুনর্বিবেচনার বিজিবির আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মামলার পুনর্বিচারে আবারও অমিয় ঘোষ খালাস দেয় বিশেষ আদালত। ন্যায় বিচারের আশায় সর্বশেষ ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে দুটি রিট পিটিশন দাখিল করলে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট রিট গ্রহণ করে আগামী ১৮ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করে।