সাফজয়ী পার্বত্য পাঁচ ফুটবলার মেয়েদের কারিগর ও নেপথ্যের আড়ালের গল্প

খাগড়াছড়ি ও রাংগামাটি পার্বত্য জেলার বাসিন্দা সাফজয়ী পার্বত্য পাঁচ ফুটবলার পাহাড়ি মেয়েদের নেপথ্য কারিগরের আড়ালে কঠিন পরিশ্রম ও প্রশিক্ষন গ্রহন করতে হয়েছে।

আনাই, আনু, ঋতুপর্ণা, মনিকা ও রুপনাদের তারকা খেলোয়াড় হয়ে উঠার নেপথ্য কারিগর ছিলেন স্কুল শিক্ষক ফুটবলপ্রেমী বীরসেন চাকমা।

তিনি এ পাঁচ নারী ফুটবলারকে গড়ে তোলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন। অর্ধের অভাবে জন্য অনেকের কাছে হাতও পেতেছেন। অনেক সময় নিজের জিপিএফ থেকে হাজার হাজার টাকা উত্তোলন করে খরচ করেছেন।

এছাড়া এই পাঁচ নারী ফুটবলারের কোচ ছিলেন সুইহ্লামং মারমা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ আনসারের কোচ। তিনি মঘাছড়ি বিদ্যালয়ের খুদে খেলোয়াড়দের বিনা পারিশ্রমিকে ফুটবলের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আর তাদের সহযোগিতা করেছেন। বর্তমানে রাঙামাটির জেলার জুড়াছড়ি উপজেলায় কর্মরত উপজেলা শিক্ষা অফিসার কৌশিক চাকমা।

আজ বিশ্বেও মানচিত্রে আনাই, আনু, ঋতুপর্ণা, মনিকা ও রুপনারা দেশের ফুটবল তারকা। হিমালয় জয়ের পর তাদের দেশ আনন্দে ভাসছে। কিন্তু বাঘিনীদের তারকা খেলোয়ার হয়ে উঠার নেপথ্য কারিগর ফুটবল সংগঠক ক্যহলাচাই চৌধুরী, বীরসেন চাকমা, কৌশিক চাকমা ও সুইহ্লামং মারমাসহ অনেকের অবদান আড়ালে রয়ে গেছে। এই কারিগরদের নামও কারো নজরে আসছে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সাতভাইয়াপাড়া পাহাড়ি গ্রামের দুই যমজ বোন আনাই মগিনী, আনুচিং মগিনী ও জেলার লক্ষ্যাছড়ির বাসিন্দা মণিকা চাকমার পরিবার ছিল হত-দরিদ্র। জন্মের পর ছোট বেলা থেকে তাদের কেটেছে অভাব আর অনটনে। আনাই মগিনী ও অনুচিং মগিনী ছিলেন পাঁচ ভাই ও দুই বোন। পরিবারের অভাব অনটন থাকায় ঠিক মতো তাদের দেখভাল করতে না পারার ভয়ে জন্মের পরপরই অনুচিং মগিনী ও আনাই মগিনীর হত-দরিদ্র পিতা রিপ্রæু মারমা সন্তানদের দত্তক দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।

অপর দিকে খাগড়াছড়ির লক্ষ্যাছড়ি উপজেলার দুর্গম সুমন্তপাড়ার গ্রামের মেয়ে মনিকা চাকমা। আনাই,-আনুচিং ও মনিকাদের খেলাধুলা তো দূরের কথা মৌলিক অধিকারের অনেক সুবিধাই ছিল না এই দুই গ্রামে। তবে প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও ক্রীড়া নিপুণতা ছিল তাদের। এরা ছোট বেলা থেকে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতো।

কিন্তু তাদের সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে আসেনি। বিষয়টি নজরে আসে রাঙামাটির মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমার। তিনি আনাই, আনুচিং ও মনিকা চাকমাকে পরিবারসহ মঘাছড়ি নিয়ে যান। সেখানে তাদের থাকার বাড়ি করে দেন। আনাই, আনুচিং ও মনিকা তখন ৩য় শ্রেণিতে পড়তেন। বীরসেন চাকমা তাদের নিজ স্কুলে ভর্তি করে দেন। ঋতুপর্ণা ও রুপনাও ছিলেন একই স্কুলের। পিতৃহীন ঋতুপর্ণাকে নিজের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেন বীরসেন চাকমা। এভাবে তিনি তার বিদ্যালয়ে পুরো একটি ফুটবল টিম গড়ে তোলেন। বীরসেন চাকমা বর্তমানে কাউখালী উপজেলার উল্টা পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

সুইহ্লামং মারমা বাংলাদেশ আনসারের কোচ ছিলেন। মঘাছড়ি বিদ্যালয়ের খুদে খেলোয়ারদের বিনা পারিশ্রমিকে ফুটবলের প্রশিক্ষণ দিতেন। তার অনুশীলনের মাধ্যমে আনাই, আনুচি, মনিকা, ঋতুপর্ণা ও রুপনাদের ফুটবলার হওয়ার প্রাথমিক যাত্রা শুরু। মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন টিমেরও কোচ ছিলেন সুইহ্লামং মারমা। কিন্তু সুইহ্লামং মারমার এই টিমের কোচ হওয়াটা কঠিন ছিল। কারণ তিনি আনসারের চাকুরি করতেন। এছাড়া আনসারের ফুটবল কোচ হওয়ায় সফিপুর থেকে মঘাছড়ি এসে অনুশীলন করানো তার পক্ষে কঠিন কাজ ছিল। তারপরও তিনি নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও খুদে ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পাশ করার পর বীরসেন চাকমা আনাই, আনুচি, মনিকা, ঋতুপর্ণা ও রুপনাদের ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন, যাতে টিমটা ঠিক থাকে।

তৎকালীন কাউখালী উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার ও বর্তমানে জুড়াছড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিসার কৌশিক চাকমা বলেন, ১জন স্কুল শিক্ষক বীরসেন চাকমা আনাই, আনু, ঋতুপর্ণা, মনিকা ও রুপনাদের আজকের এই পর্যায়ে নিতে অনেক কষ্ট করেছেন। নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন। অর্থের জন্য অনেকের কাছে হাত পেতেছেন। অনেক সময় নিজের জিপিএফ থেকে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করে খরচ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সকলের ঐকান্তিক চেষ্টায় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০১১ সালে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন ও ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে রানার্স আপ হয়। অনূর্ধ্ব-১৫ উচ্চ বিদ্যালয় পর্যায়ে কাউখালীর ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের আনাই, আনুচিং, মনিকা, ঋতুপর্ণা ও রুপনারা ময়মনসিংসের কলসিন্দুর উচ্চ বিদ্যালরে মারিয়া মান্ডা সানজিদাদের পরাজিত করে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যায়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন। এর পর জাতীয় দলে ডাক ও অন্তর্ভুক্তি। পরের গল্পতো সবারই জানা।

হিমালয় জয় করেছে নারী ফুটবলাররা। তার রেশ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশের পাহাড়েও। খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সাতভাইয়াপাড়া পাহাড়ি গ্রামের দুই যমজ সন্তান আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনী। বয়সভিত্তিক দল থেকে এখন জাতীয় দলের নির্ভরতার প্রতীক। জেলার লক্ষ্যাছড়ির বাসিন্দা মনিকা চাকমা বাংলার মাঝমাঠে খেলছেন দীর্ঘদিন।

এছাড়াও দলের সঙ্গে আছেন খাগড়াছড়ি সদরের আপার পেরাছড়ার বাসিন্দা তৃষ্ণা চাকমা। তিনি মনিকাদের সহকারী কোচ। হত-দরিদ্র পরিবরের জন্ম নেওয়ায় শৈশব তাদের কেটেছে অভাব আর অনটনে। নিয়তির কী খেল! তাদের কল্যাণেই পরিবারগুলো এখন আলোকিত।

অভাব দূর হয়ে ফুটেছে সচ্ছলতার হাসি। সে সঙ্গে দেশের মুখ করেছেন উজ্জ্বল। পুরো দেশের পাশাপাশি উচ্ছাস একটু বেশি ধরা দিয়েছে পার্বত্য জনপদ খাগড়াছড়ি, রাংগামাটি, বান্দরবান। আনাই ও আনুচিং, মনিকার পরিবার ছাড়াও উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন জেলার ক্রীড়া সংগঠকরা।

সার্থক পুরস্কার ঘোষণা করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস। তিন ফুটবলার আনাই মগিনী, আনুচিং মগিনী ও মনিকা চাকমাসহ সহকারী কোচ তৃষ্ণা চাকমাকে এক লাখ টাকা করে পুরস্কারের ঘোষণা দেন তিনি। এসময় সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান খাগড়াছড়ির এ জেলা প্রশাসক।

গণমাধ্যমকে জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস আরো বলেন, ‘সমাজের বিভিন্ন বিত্তবান মানুষ আছে, বিত্তবান এজেন্সি আছে। কীভাবে আমাদের নারী ফুটবলকে আরও এগিয়ে নেয়া যায়, তারা সবাই এ বিষয়টা নিয়ে ভাববে। তাদের জন্য কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা যায় সেটা নিয়ে ভাববে। আজকে তারা সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কিন্তু যে সম্ভাবনা তারা দেখিয়েছে, সঠিক পরিচর্যা করলে এ মেয়েরা এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও শিরোপা জিততে পারবে।’
পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পাহাড়ে নারীরা ফুটবলে আরও অবদান রাখতে পারবে বলেও এসময় জানান তিনি। খাগড়াছড়ি ফুটবল খেলে ইতিহাস গড়লো বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। ১৯ বছরের খরা কাটিয়ে এবার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তুলেছে অপরাজিতা চ্যাম্পিয়ন বাঘিনীরা। বাংলোদেশের মেয়েরা নেপালের মাটিতে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে নিজেদের ঘরে তুলেন।

এদিকে সাফ জয়ী বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের অদম্য গোলকিপার রূপনা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমার বাড়িতে মিষ্টি-ফলসহ নানা উপহার নিয়ে গেছেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। গত মঙ্গলবার তিনি তাদের পরিবারের হাতে নগদ দেড় লাখ টাকা করে দুটি চেক তুলে দেন। জেলা প্রশাসক আবেগে আপ্লুত হয়ে রূপনা ও ঋতুপর্ণার পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দেন। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বজলুর রহমানকে রূপনার জরাজীর্ণ ঘরটির স্থলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত নতুন ঘর নির্মাণ এবং তার বাসায় যাওয়ার সড়কটি তৈরি করে দেওয়ার নির্দেশনা দেন। নানিয়ারচরের ঘিলাছড়ির ভুঁইয়াদম এলাকায় রূপনার বাসা থেকে বেরিয়ে জেলা প্রশাসক আরেক জাতীয় তারকা ঋতুপর্ণা চাকমার বাড়িতে যান।

ঘাগড়া ইউনিয়নের মগাছড়িতে তার বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি ও উপহার তুলে দেন এবং তার পরিবারকে নগদ দেড় লাখ টাকার চেক তুলে দেন। একই সময় তিনি তার বাড়িতে যাওয়ার সড়কটি নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এ সময় জেলা প্রশাসন সবসময় তার পরিবারের পাশে থাকবে বলেও জানান তিনি। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) সাইফুল ইসলাম, মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নিরূপা দেওয়ান, সাবেক জাতীয় ফুটবলার বরুণ দেওয়ান, জেলা স্কাউটের নেতা নুরুল আবছার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রূপনা ও ঋতুপর্ণ আজ পুরো জাতির গর্ব। আমরা তাদের নিয়ে গর্বিত। তাদের পরিবারের পাশে আমরা সবসময় থাকার চেষ্টা করব।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘বাংলাদেশের এ জয়ের বড় অংশীদার খাগড়াছড়ির ফুটবলাররা। তাদের এ অর্জনে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন ফুটবলার ও এক কোচের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে মোট চার লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তুলেছে অপরাজিতা চ্যাম্পিয়ন বাঘিনীরা।

গত সোমবার(১৯শে সেপ্টেম্বর) কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মতো শিরোপার জয় পায় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। ফাইনালে নেপালের কাঠমান্ডুতে স্বাগতিকদের ৩-১গোলে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। এমন দুর্দান্ত জয়ে গোটা দেশে আনন্দ উল্লাস। দেশের ফুটবলের অনন্য এই জাগরণ দেখলো সবাই।