২৬ জানুয়ারী চুয়াডাঙ্গার ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার ৪৪ বৎসর অতিবাহিত

প্রতিদিনই চুয়াডাঙ্গাসহ সারাদেশেই কোথাও না কোথাও সড়ক পথে বিভিন্ন যানবাহনের দ্বারাই মানুষের মৃত্যু হচ্ছেই। সে দুর্ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখে থাকলেও বর্তমানে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশনের মাধ্যমে এখন সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে মৃত্যুর সংবাদ।

কেউ অল্প আঘাতে আবার কেউ বড় দুর্ঘটনায় বীভৎস রুপ নিয়ে মারা যাচ্ছে। সেচিত্র যে দেখেছে তার মন কাঁদলেও চোখের জল কিন্তু থেমে থাকেনা মারা যাওয়া স্বজনদের।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, প্রতিদিন সারাদেশে ৬০ থেকে ৭০ জনের মত জ্যান্ত মানুষ লাশ হচ্ছে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকরুপে। তারমধ্যে কারো স্বজন না হলেও কিন্তু আত্মার অনুভূতির স্তম্ভে খারাপ লাগে বেশিরভাগ মানুষেরই। তবে কখনও ট্রেন লাইনচ্যুত বা দুর্ঘটনা ঘটে থাকলেও যাত্রী মরে যাওয়ার খবর অবশ্য শোনা যায়না বললেই চলে। যা দুএকজন মারা গেলেও তারপরও মায়ার জালে একবার হলেও একটু দুঃখ প্রকাশ হয় সমাজের বেশির ভাগ মানুষেরই।

কিন্তু সব দুর্ঘটনাকে হার মানিয়ে বাংলাদেশের ছোট একটি জেলায় ভয়াবহ বীভৎস ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে চুয়াডাঙ্গায়। যে ঘটনার বর্ণনা শুনতেই স্তব্ধ হয়ে পড়ে চুয়াডাঙ্গার মানুষ।
সে দুর্ঘটনায় হঠাৎ করেই ট্রেনের বগিতে লোহায় লোহায় ধাক্কা খাওয়ার শব্দ শুনতে পায় ঘটনাস্থলের রেললাইনের ধারের বসবাস করা মানুষগুলো। বিকট শব্দে একটি গ্রামের শত শত মানুষ বিশেষ করে রেললাইনের আশেপাশের মানুষ ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হয় প্রথম দিকে। সেসময় তাৎ¶ণিক বেরিয়ে আসা মানুষগুলো দেখে ট্রেনের সবকটা বগি ওলোট পালট হয়ে বগির ওপর বগি পড়ে আছে। সেইসাথে ট্রেনে থাকা যাত্রীদের মধ্যে একেকজনের বীভৎস সারি সারি লাশের রক্তে ভেসে যাচ্ছে দুর্ঘটনা কবলিত স্থান। কারো হাত কারো পা কারো পুরো বডি বগির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থায় বাঁচার আকুতি নিয়ে সাহায্য চাচ্ছে স্থানীয়দের কাছে।

এ করুণ অবস্থায় গ্রামের মানুষ স্তব্ধ হয়ে পড়লেও সেসকল যাত্রীদের বাঁচার আকুতি দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি তারা। সবাই যাত্রীদের বাঁচানোর নেশায় কাছে এগিয়ে গেলে দেখা যায় কারো হাত কারো পা আটকে রয়েছে ট্রেনের নিচে; বের করতে হচ্ছে হাত পা কেটে। বগির নিচে কারো পুরো দেহসহ শত শত মানুষ স্পট ডেট হয়ে পড়ে আছে প্রতিটি বগিতে। অনেকেই এ আতঙ্কিত দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের পানির তৃষ্ণা মেটাতে স্থানীয়রা বাড়ী থেকে কলস কলস পানি এনে খাওয়াচ্ছে আর সেসময় পানি খেতে খেতে কেউ বেঁচে যাচ্ছে আবার কেউ ছটফট করতে করতে মারাও যাচ্ছে। এ বীভৎস দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যায় ট্রেনের অনেক যাত্রী। সেসময় গ্রামের মানুষের চোখের মনিকাছেই এ ভয়াবহ চিত্র দেখতে হয়েছে তাদের। পরে জানাজানি হলে পুরো চুয়াডাঙ্গা জেলাজুড়েই ভয়াবহ এ আতঙ্কের কথা ছড়িয়ে পড়লে জেলার মানুষ সচিত্র না দেখলেও স্তব্ধ হয়ে পড়ে।

এভাবেই কারো পুরো পরিবার কারো বাবা কারো মা কারো ভাই কারো বোন বীভৎস রুপ নিয়ে সেসময়কার সরকারী হিসাব অনুযায়ী ৭৪ জনের লাশের রেললাইনের পাশের নিচু জমির মাটিতে জমাট বেঁধে যেন পুকুর তৈরী হয়েছিল লাল রক্তের।

কিন্তু স্থানীয়দের সচিত্র অনুযায়ী প্রায় ৫শর মত যাত্রীর মৃত্যু হয় সেসময়। আর আহত হয় শত শত মানুষ। ১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারী অর্থ্যাৎ ৪৪ বছর পার পার হয়ে গেলেও চুয়াডাঙ্গাবাসীর এ দিনটির কথা মনে পড়ে এখনও। যখনই মনে হয় তখনই সেকাল আর একালের মানুষের শিউরে ওঠে শরীর। ভয়ে কেঁপে ওঠে তাদের আত্মা।

সেসব লাশের বীভৎস চিত্র সারাদেশের এক ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার অনন্য ইতিহাসের জন্ম দেয় চুয়াডাঙ্গার গাইদঘাট রেল স্টেশন। যা আর কোন দুর্ঘটনা গত ৪৪ বছরে ঘটেনি সারা বাংলাদেশের কোথাও। আর এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন গাইদঘাট গ্রামের সেসময়কার সচিত্র দেখা বৃদ্ধ মানুষগুলো।

প্রত্যক্ষদর্শী গাইদঘাট গ্রামের গোলাম রসুল বলেন, ‘ঐ দিন দুপুরে আমরা তিন বন্ধু ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। রেললাইনের একটু দূরেই আমাদের বাড়ি। কোরের মাঠ থেকে বিকট আওয়াজ শুনে দৌড়ে গেলাম দেখতে। এসে দেখি দুর্ঘটনার ভয়াবহতা। ট্রেনের আহত যাত্রীরা যে যেমন পারছে ছুটাছুটি করছে। পুরো এলাকা ধুলোই অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমরা তিন বন্ধু বাড়ি থেকে কলসে করে পানি নিয়ে আসলাম তাদের সাহায্য করার জন্য। তারপর গ্রামের লোকজন সব এগিয়ে আসলো উদ্ধার করার জন্য। ট্রেনের ইঞ্জিন ছিটকে পড়েছে পাশের মাঠের মধ্যে। ট্রেনের বগি উঠে গেছে একটার উপরে আর একটা। বগির ভিতরে বীভৎস লাশের পর লাশ ডিঙিয়ে যেতে হচ্ছে আহতদের কাছে! আমরা তখন রেডিওর খবরে শুনতে পাই ৭৪ জন নিহত হয়েছেন। কিন্তু গ্রামবাসীদের হিসাবে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি যা পাঁচশতাধিক মানুষ নিহত হয় সেসময়।

একই গ্রামের মোহাম্মদ আলমগীর কবির বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় আমি খুব ছোট ছিলাম, তখন আমার মাত্র ১২ বছর বয়স ছিল। তবু সেই কথা পরিষ্কার মনে পড়ে। দুর্ঘটনার কথা শুনে দৌড়ে গেলাম কোরের মাঠে। যেয়ে দেখি আহত যাত্রীদের বাঁচার আর্তনাদ।

ঐ গ্রামের সিদ্দিকুল হাসান খোকন বলেন, ‘দুর্ঘটনার দিন আমি দর্শনার শ্যামপুর গ্রামে ছিলাম। রাইটা নামে একটি ট্রেনে ফেরার পথে দুর্ঘটনার স্থানে আমাদের ট্রেনটি হঠাৎ থেমে যায়। ট্রেন থেকে নেমে দেখি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শত শত মানুষ লাশ হয়ে পড়ে আছে বগির ভেতর ও বাইরে। শত শত লাশ সারি বদ্ধভাবে সাজানো দেখে ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে আমি বাড়ি চলে যায়।

গাইদঘাট গ্রামের ইদু মন্ডল, আব্দুল খালেক, পাশের জয়রামপুর গ্রামের সামসুল হকসহ আরও অনেক মানুষ ছিলেন সে সময়ের ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী। সেদিনের দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এখনো মনে নাড়া দেয় ২৬ জানুয়ারী আসলেই। তারা যখন নিজের মুখে সে দুর্ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল তখন তা শুনে বোঝা যাচ্ছিল এ দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কতটা কঠিন। সেসময় প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে মুখে এখনো আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট রয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মিজানুর রহমান বলেন, ‘১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি দুপুরে জয়রামপুর এবং চুয়াডাঙ্গার মাঝামাঝি গাইদঘাট নামক স্থানে আপ রকেট মেইল ট্রেনটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আমি জেনেছি সে সময় বহু মানুষ নিহত এবং আহত হয়’।

১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি এ গ্রামের কোরের মাঠ নামক স্থানে ঘটে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। যা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ওইদিন বেলা ১টা ২০ মিনিটে খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী রকেট মেইল ট্রেনটি চুয়াডাঙ্গার গাইদঘাটের কোরের মাঠে পৌঁছালে দুর্ঘটনা কবলিত হয়। যা ইতিহাসের ভয়াবহ এ ট্রেন দুর্ঘটনা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস অথচ শেষের বগিটা ছাড়া সব বগিই পড়ে গিয়েছিল লাইন থেকে। বগির ওপর উঠে গিয়েছিল বগি। এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি স্মৃতিসস্তম্ভ করা হয়। যা এখনও পর্যন্ত অযত্ন অবহেলায় প্লাস্টার ঝুরে ঝুরে পড়ছে এখনও। তবুও সংস্কার কোন উদ্যোগ দেখা যায় না সরকারীভাবে।

বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, এই দুর্ঘটনার আগেও ১৯৪০ সালে একই স্থানে ট্রেন দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন মানুষ মারা যায়। ১৯৭৯ সালের ৩০ অক্টোবর একই স্থানে ঘটে আরেকটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট আবারো এখানে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায় ৪ জন।

ঘটনার দীর্ঘ ৪৪ বছর পরও ওই পথটি ঝুঁকিমুক্ত কমেনি। বরং দিন যতই যাচ্ছে ততই কঠিন হয়ে পড়ছে। এই স্থানের ৩ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েই গেছে এখনও। সারা দেশের অন্যতম দুর্ঘটনা হলেও এ জায়গায় কেন দুর্ঘটনা ঘটে তা এখনও পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারিনি সরকার। গাইদঘাট গ্রামের ওপর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-খুলনা, রাজশাহী-খুলনা, পার্বতীপুর-খুলনা ও ঢাকা-কলকাতা রেললাইন। এ রেলপথে ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী ট্রেনসহ বেশ কয়েকটি যাত্রীবাহি ট্রেন ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করে। এই রেললাইনটি দেখতে অনেকটা ধনুকের মতো বাঁকা এবং রেললাইনের দুই পাশে নিচু জমি। এ তিন কিলোমিটার রেলপথটি ভয়াবহ গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ আমলের পর থেকে এ স্থানে বড় ধরনের সংস্কার করা হয়নি। ফলে সবসময়ই ঝুঁকির মধ্যেই রয়ে গেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার গাইদঘাট এলাকার রেলপথ।

চুয়াডাঙ্গা ইতিহাস পরিষদের পরিচালক অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী বলেন, ‘১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি গাইদঘাটে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর ১৯৮১ সালে এখানে গাইদঘাট রেলওয়ে স্টেশন ও ট্রেন দুর্ঘটনার স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। আর এ স্টেশনকে কেন্দ্র করে এখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও হাট বাজার গড়ে উঠে। কয়েক বছর পরই স্টেশনটি বন্ধ ঘোষণা করে রেল কর্তৃপক্ষ। গাইদঘাট স্টেশনের টিনশেড ভবনটি এখন অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে আছে এবং দুর্ঘটনার স্থানের স্মৃতিসৌধটির পলেস্টারা উঠে গেছে এবং ফাটল ধরে ভেঙে পড়ার উপক্রম তৈরী হয়েছে। গাইদঘাট রেলস্টেশনের পাশে যে রেলগেটটি আছে তা এখনো অরক্ষিত রেলগেট হিসেবে চিহ্নিত।

ফলে এ এলাকাটি এখনো দুর্ঘটনার ঝুঁকিতেই রয়েছে। আর এই মৃত্যুঝুঁকির মধ্যদিয়েই পারাপার হতে হয় ব্যস্ততম এই রেলগেটটি’।