৭৫ মামলার পলাতক আসামি তারেক রহমান

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক-সরকারের আমলে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান গ্রেফতার হন। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান জামিনে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনে পাড়ি জমান। সেই থেকে তিনি পরিবার নিয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানে থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার পর ২০১৮ সালের ৯ ফেরুয়ারি থেকে লন্ডনে বসেই বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।

লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হত্যা, দুর্নীতি ও মানহানির অভিযোগে ৭৫ মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ আরও পাঁচ মামলায় তাকে কারাদণ্ড দেন আদালত। সব মামলায়ই তিনি পলাতক।

আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ৭৫ মামলার মধ্যে মানহানির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ৬৫টি পিটিশন মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা হয়েছে তিনটি মামলা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি করে মামলা রয়েছে। চাঁদা দাবির অভিযোগসহ অন্য দণ্ডবিধি ধারায় পাঁচ মামলা রয়েছে।

বহুল আলোচিত এক/এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানো হয়। এর অংশ হিসেবে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য রিমান্ডেও নেওয়া হয় তাকে। ১৮ মাস কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান তিনি। ওই ১৮ মাসে ১৩ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তারেককে। ১৩ মামলায় ধাপে ধাপে তাকে জামিন দেওয়া হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আটদিন পর ১১ সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় তারেক রহমানের ৯ বছর ও তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ কারাদণ্ডাদেশ দেন। রায়ে দুদক আইনের ২৬ (২) ধারায় তারেক রহমানের তিন বছর ও ২৭ (১) ধারায় ছয় বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। দুই ধারার সাজা একসঙ্গে চলবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। এছাড়া দুদক আইনের ২৭ (১) ধারায় জোবায়দা রহমানের তিন বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। পাশাপাশি তারেক রহমানকে তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও তিন মাস সাজাভোগ করতে হবে।

সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচার মামলা
২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের একটি মামলায় ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেন। ওই মামলায় তারেকের বন্ধু ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানকে খালাস দেওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে দুদক। ওই আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ২১ জুলাই বিচারিক আদালতে খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেন।

 

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানের দশ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার ৫ নম্বর অস্থায়ী বিশেষ জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। বিচারিক আদালত খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিলেও রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে উচ্চ আদালত কারাদণ্ড দ্বিগুণ করে দশ বছর করেন।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে অবস্থিত ঢাকার ১ নম্বর অস্থায়ী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন এ রায় ঘোষণা করেন।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা
একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলায় তারেক রহমানকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই দিন (২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর) ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন এ রায় ঘোষণা করেন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির মামলা
২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে আয়োজিত এক সমাবেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নানান মন্তব্য করেন তারেক রহমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে নড়াইলে একজন মুক্তিযোদ্ধার দায়ের করা মানহানি মামলায় ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন জেলার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২। একই সঙ্গে তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে বিএনপির সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ জাগো নিউকে বলেন, তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য বিভিন্ন মামলা দায়ের ও সাজা দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেন, মামলার ক্ষেত্রে সব আসামিই সমান। যেহেতু সে দণ্ডিত তাই তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করতে হবে। আর যেহেতু তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সেক্ষেত্রে পলাতক না থেকে দেশে ফিরে তারেক রহমানের আইনি লড়াই করা উচিত।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, পলাতক আসামিদের নিয়ে আসার প্রসেস আছে। মামলায় যখন আসামি হাজির না হয় বার বার সমন দেওয়ার পরও হাজির না হলে পলাতক হিসেবে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়।

এরপরও হাজির না হলে আসামির অনুপস্থিতিতে রায় দেন আদালত। তবে, সাজা কার্যকরে আসামিকে দরকার। এপর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটা আদেশ যায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। তখন ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় রেড নোটিশ জারি করার জন্য।

রেড নোটিশ জারি করার পর আসামি যে দেশে অবস্থা করছে সে দেশ যদি মনে করে অপরাধী বা আসামিকে নিজ দেশে পাঠানো প্রয়োজন, তারা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে ফেরত পাঠাতে পারে। যেমন তারেক রহমান অবস্থান করছে যুক্তরাজ্যে। এখন যুক্তরাজ্য যদি মনে করে তারেক রহমানকে দেশে পাঠানো প্রয়োজন।

তখন ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার করে নিজ দেশে পাঠাবে। আর তারা যদি মনে করে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া দরকার তাহলে দেবে। এটা হচ্ছে তাকে দেশে আনার আইনগত প্রসেস। এ আইনগত প্রসেস এবং আন্তর্জাতিক ইস্যু আছে। এখন কোর্ট যেটা করতে পারেন তার অনুপস্থিতিতে রায় দিতে পারেন। রায় কার্যকর হওয়াটা সময়সাপেক্ষ বিষয়।

এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা কী জানতে চাইলে ফারুক হোসেন বলেন, আমাদের ভূমিকা হচ্ছে যখন রায়ের কপি আসবে তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে রেড নোটিশ জারির যে প্রসেস আছে সেটা করা। রেড নোটিশ জারি হওয়ার পর যদি যুক্তরাজ্য তাকে আমাদের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় তখন আমাদের পুলিশের একটি প্রতিনিধিদল তাকে গ্রেফতার করে দেশে আনবে।