কুড়িগ্রামে বর্জ্য থেকে জ্বালানী তৈরী করে সাড়া ফেলেছে এইচএসসি পরীক্ষার্থী
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে পারভেজ মোশাররফ নামের এইচএসসি পরীক্ষার্থী পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতল পুড়িয়ে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল তৈরি করছেন। তার এ প্রতিভাকে এক নজর দেখতে বাড়িতে ভিড় করছেন এলাকাবাসী।
এতে এলাকাজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পারভেজ মোশারফের তৈরি করা তরল জ্বালানি এক সময় খনিজ সম্পদে প্রভাব ফেলে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে বলে সচেতন মহলের ধারণা।
সরেজমিনে গিয়ে ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার পাথরডুবী ইউনিয়নের মইদাম গ্রামের কৃষক বদিউজ্জামানের পুত্র পারভেজ মোশাররফ (১৯)। বাড়ীর উঠানেই একটি আবদ্ধ ড্রামে পরিত্যক্ত পলিথিন রেখে আগুনে তাপ দিয়ে পলিথিন গলিয়ে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেন তৈরি করেছেন। এসব জ্বালানি দিয়ে মটর সাইকেল চালনা করে এলাকার মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে। এছাড়া মাটি ও পানিতে ওই তরল পদার্থ ফেলে আগুন প্রজ্বলিত করে পেট্রোল প্রমাণ করেছেন। তার দেয়া পেট্রোল ও অকটেন ব্যবহারকারী এলাকার বেশ কিছু মটর সাইকেল চালক বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আর ডিজেল দিয়ে চলছে কৃষিতে ব্যবহৃত পাওয়ার টিলার ও সেলো মেশিন।
পারভেজ মোশাররফ জানান, সে মইদাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি পাশ করে। পরে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত মইদাম মহাবিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেনিতে ভর্তি হন। আড়াই বছর আগে ইউটিউবে তৌহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তৈরির একটি ভিডিও দেখেন। পরে সেখান থেকে রিসার্চ করে তিনি পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতল পুড়ে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল তৈরির চেষ্টা করেন। সেসময় প্রায় ১২০ লিটার জ্বালানি তেল সংগ্রহ করেন। পরে সারা দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় তার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ দিন পরে তার কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় গত ১৯ আগস্ট থেকে পুনরায় জ্বালানি উৎপাদনের কার্যক্রম শুরু করেন।
পারভেজ জানান, পরিত্যক্ত পলিথিন যত্রতত্র ফেলে না দিয়ে এগুলো সংগ্রহ করে একটি আবদ্ধ প্রকোষ্ট ড্রামে ভিতরে রেখে আগুনে অতিমাত্রায় তাপ প্রয়োগ করে গলিয়ে ফেলা হয়। বাস্পায়িত হয়ে ডিজেল এবং নল দিয়ে বের হয়ে পেট্রোল অকটেন তৈরি হয়। সর্বশেষ পাইপ দিয়ে গ্যাস বের হলে সেখানে আগুন দিলে আগুন লেগে থাকতো। যত তাপমাত্রা বেশী দেয়া হত তত বেশী তরল পদার্থ নির্গত হয়। সেই সাথে গ্যাস বের হয়। এসব সংগ্রহীত তরল পদার্থ ছাকনি দিয়ে পরিশোধন করা হয়।
উদ্ভাবক পারভেজের দাবী, এই তরল পদার্থ গুলো হাইড্রোকার্বন তাই এগুলো ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও এলপি গ্যাস। তিনি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার সুযোগ না পেলেও প্রাথমিকভাবে মাটিতে ঢেলে আগুন দিয়ে পরীক্ষা করেছেন।
তিনি জানান, কয়েক হাজার টাকা খরচ করে বাজার থেকে তেলের একটি বড় টিনের ড্রাম, একটি মাঝারি প্লাস্টিকের ড্রাম, ছোট দুইটি ড্রাম ও কন্টেইনার, প্রায় ৭ ফুট স্টিলের পাইপ ও কয়েক হাত প্লাস্টিকের ফিতা কিনে কাজ শুরু করেন। পরিত্যাক্ত পলিথিন ৩০ টাকা কেজি দরে কিনে নেন। এরপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় পলিথিনগুলো টিনের ড্রামে ভরে প্রায় আধাঘণ্টা ড্রামের নিচে খড়ি দিয়ে জ্বাল দেন। এতে প্রায় ১ মণ জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয়। এরপর ড্রাম থেকে নির্গত গ্যাস স্টিলের পাইপ দিয়ে এসে প্লাস্টিকের ড্রামের মধ্যে রাখা পানিতে ঠাণ্ড হয়ে প্রেট্রোল এবং ডিজেল ছোট কন্টেইনারে জমা হয়। ১০ কেজি পলিথিন থেকে প্রায় ৭ লিটার জ্বালানি পাওয়া যায়। প্রতি লিটার জ্বালানি ১০০ টাকায় বিক্রি করা যায়।এর মধ্যে উছিষ্ট পলিথিনের ছাই ফটোসষ্ট্যাট মেশিনের কালি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ওই জ্বালানি দ্বারা মোশাররফ নিজের মোটর সাইকেল চালান বলে জানান।
তবে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্টপোশকতা পেলে তার এ প্রতিভা বিকশিত করা সম্ভব বলে মনে করছেন সচেতন এলাকাবাসী।
মোটর সাইকেল চালক হাবিল উদ্দিন ও রুবেল জানান, ওই জ্বালানি দ্বারা মোটর সাইকেল চালাচ্ছি কোন সমস্যা হচ্ছে না।
পাথরডুবী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সবুর বলেন, আগে জানতাম পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এ পলিথিন থেকে যে জ্বালানি তেল তৈরি করা হয় তা জানতে পেরে খুব ভালো লাগছে। পলিথিনের এ ধরনের পুনর্ব্যবহারই পারে পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনতে। এ ব্যাপারে সরকারের উচিত পারভেজের পাশে দাঁড়ানো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, ড. মোঃ সাইফুর রহমান সরকার বলেন, পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য হতে জ্বালানী পদার্থ যথা ডিজেল, পেট্রল বা অক্টেন উৎপাদনে পারভেজের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। এ ধরণের উৎপাদন বানিজ্যিকভাবে করা গেলে তা যেমন পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়ক হবে তেমনি জ্বালানীর চাহিদা পূরণেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে। প্রকৃতপক্ষে, সারা বিশ্বের বৈজ্ঞানিকগণ পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য হতে জ্বালানী উৎপাদন বিষয়ে গবেষণা ও পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তারা অনেকাংশে সফল হয়েছেন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য হতে বিভিন্ন জ্বালানী উৎপাদনের প্লান্ট রয়েছে।
প্লাস্টিক বা পলিথিন হলো মূলত দীর্ঘ কার্বন শিকলযুক্ত বৃহৎ অণু। জ্বালানী হলো কার্বনযুক্ত তুলনামূলক ছটো আকারের অণু। দীর্ঘ কার্বন শিকল প্রয়োজনীয় দৈর্ঘ্যে ভেঙ্গে জ্বালানী পাওয়া যায়। তাপ প্রয়োগে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায় এবং যথাযথ প্রভাবক ব্যবহারে প্রক্রিয়াটি সহজতর হয়। এটি মূলত পলিমার পদার্থের তাপীয় ভাঙ্গন (ডিপলিমারাইজেশন) প্রক্রিয়া। তবে এখানে মূল চালেঞ্জ হলো উৎপাদন খরচ কমানো যা যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে অতিক্রম করা সম্ভব।
এ ব্যাপারে ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মা বলেন, পারভেজ মোশাররফের পলিথিন পুড়ে পেট্রোল তৈরির বিষয়টি শুনেছি । এটি একটি ভাল উদ্যোগ। তবে এর কার্যকারিতা কতটুকু ও পরিবেশবান্ধব কি-না তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্ণয় করা হবে। পরিবেশ বান্ধব হলে তা আরো উন্নতভাবে তৈরি করতে তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন