কঠোর ইসলামি আইনের দেশ ব্রুনেই আসলে কেমন?

পরিচ্ছন্ন পরিপাটি রাস্তাঘাট গুলো গাছে গাছে সাজানো আর সাথে পথচারীদের জন্য আছে পর্যাপ্ত জায়গা।

বন্দর সেরি বেগাওয়ান- ব্রুনেই এর রাজধানী, নিয়ম মাফিক চলা অত্যন্ত শান্ত ও নিরাপদ শহর।

মসজিদের দৃষ্টিনন্দন মিনার, কিছু দারুণ কারুকাজ এবং সুলতানের বড় বড় ছবি- আপনাকে বলে দেবে এটি ব্রুনেই।

বিশ্বজুড়ে সর্বশেষ টিকে থাকা রাজতন্ত্রগুলোর একটি এটি।

এখানে সুলতানের হাতেই সব নির্বাহী ক্ষমতা।

তিনি একই সাথে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থমন্ত্রী এবং হেড অফ ইসলাম। তার কথাই এখানে আইন।

ক্রমশ ধর্মের দিকে যাওয়া
এক সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ছিলো। পরে ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতার পর সুলতান মালয় মুসলিম রাজতন্ত্রের ধারণা ঘোষণা করেন।

দেশটি আসলে মালয় ভাষা, সংস্কৃতি ও প্রথার একটি মিশেল, যেখানে ইসলামি আইন শেখা ও রাজতন্ত্রকে শ্রদ্ধা করা ও মেনে নেয়া এবং চর্চা করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক।

এখানে ভিন্নমতের কোনো জায়গা নেই, যদিও ব্রুনেইয়ের সব মানুষ মালয় গোত্রের নয়।

স্বাধীনতার পর থেকেই সুলতান ক্রমশ ব্রুনেইকে ইসলামি কঠোর নিয়ম কানুনের দিকে নিয়ে যান।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডমিনিক মুলার যিনি ব্রুনেই সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন।

তার মতে, “১৯৮৭ সালে হজ করে আসার র থেকেই গত তিন দশকে সুলতান ধর্মের দিকে বেশি করে এগিয়েছেন। তিনি শরিয়া আইন চালু করার ক্ষেত্রে বারবারই আল্লাহর দিক থেকে আসা বাধ্যবাধকতার ওপর জোর দিয়েছেন”।

তিনি বলেন ইসলামি আমলাতন্ত্রের প্রভাব অতিরঞ্জিত নয়।

ব্রুনেইতে কোনো বিরোধী দল নেই, এমনকি স্বাধীনতার পর থেকে কোনো স্বাধীন সিভিল সোসাইটি গ্রুপও গড়ে উঠেনি।

১৯৬২ সালে যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিলো, কার্যত সেটিই চলছে এখনো, যেখানে সমাবেশ ও মত প্রকাশের অধিকার দারুণভাবে সীমিত।

গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনা এবং কেউ ‘সীমা লঙ্ঘন’ করলে বন্ধ করে দেয়ারও নজির আছে।

সরকারের বিরোধিতা গণ্য হতে পারে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবেও, যার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।

আর এসব কারণে বিদেশী সাংবাদিকদেরও কাজ করা কঠিন।

যদিও মানুষজন খুবই আতিথেয়তা ও সহযোগিতা প্রবণ।

কিন্তু তার পরেও একজন মানুষও নতুন শরিয়া আইন নিয়ে একটি মন্তব্যও অন রেকর্ড করতে রাজী হয়নি।

এমনকি বিবিসি টিমের সাথে দেখা করার ক্ষেত্রেও অনেকে ছিলেন নার্ভাস।

আবার কিছু বিষয়ে সরকারের মন্তব্য চাইলেও কোনো জবাবই পাওয়া যায়নি।

জীবন সেখানে কতটা স্বাভাবিক
বিবিসি দলটি সেখানে একটি মসজিদে একদল লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন যারা খুবই ধর্মপ্রাণ।

আবার একজন সমকামী নারীর সাথেও কথা হয়েছে তাদের চ্যাটিংয়ে।

আর একজন সমকামী পুরুষের সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে আরও কয়েকজনের সাথে।

এদের কেউই নতুন ফৌজদারি আইনে পাথর ছুড়ে মারার মতো কঠোর শাস্তিতে বিশ্বাস করেননা।

অবশ্য কার্যত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সেটি কার্যকর থেকে আপাতত পিছিয়ে এসেছেন সুলতান।

আবার ব্রুনেইয়ের মানুষও বিভক্ত নতুন আইন নিয়ে বিশেষ করে সমকামীদের বিষয়ে।

তবে এখন স্বস্তি এসেছে কারণ সুলতান বলেছেন নতুন আইন এখনি প্রয়োগ হচ্ছেনা, আর সুলতানের কথাই সেখানে আইন, বলছিলেন সমকামী এক নারী।

অর্থনীতি, ভবিষ্যৎ
রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানে বিবিসি সংবাদদাতা কথা বলেন দুজন তরুণ পেশাজীবীর সাথে বিশেষ করে গত দু দশকে তেল ও গ্যাস থেকে আসা অর্থে উন্নত হওয়া ব্রুনেইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেলের দাম কমে যাওয়ায় সরকারকে বাজেট ঘাটতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

চাকরীর প্রথাগত উৎস অর্থাৎ সরকারি খাত সংকুচিত হওয়ায় বেকারত্ব বেড়েছে আর কমেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও।

তবে সরকারের একটি কর্মসূচি আছে ভিশন ২০৩৫ নামে। কিন্তু তারপরেও উন্নতি আটকে আছে।

তরুণ পেশাজীবীদের একজন বলেন, “দেশের ভবিষ্যতের বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। সরকারই সব সিদ্ধান্ত নেয়”।

শনিবার রাতে ব্রুনেই থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার সীমান্তে জট লেগে যায়। ব্রুনেইয়ের বহু মানুষ মদ্যপান, ধূমপান কিংবা সঙ্গীত— আনন্দ করতে সেখানে যায় কারণ দেশে এসব নেই।

দেড় ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে তারা এসবের জন্য ছুটে যায় নিকটবর্তী মালয়েশিয়ার একটি শহরে যার নাম লিমবাং।

সেখানকার বারগুলো ভরে যায় আর সামনে যত গাড়ি তার প্রায় সবগুলোতেই থাকে ব্রুনেইয়ের নাম্বার প্লেট।

সেখানেই একটি বারে ব্রুনেই থেকে আসা একদল ব্যক্তিকে পান বিবিসি সংবাদদাতা।

শরিয়া আইন নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন তারা ?

এমন জবাবে তারা বলেন, “না খুব বেশি না। আমরা এখানে আসাতে কোনো বাধা পাইনা। আর ব্রুনেইতেও আরামেই বাস করি। তাহলে উদ্বেগের কি আছে?”