গণধর্ষণের পর নদীতে শিশু : ৫ লাখ টাকায় দফারফা!

নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশের ওসির বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর চতুর্থ শ্রেণির এক শিশু ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ৫ লাখ টাকায় দফারফার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বাবাহারা প্রবাসী মায়ের এতিম শিশুটি পুলিশ ও প্রভাবশালীদের চাপে বাকরুদ্ধ। ভয়ে আতঙ্কিত পুরো পরিবার। পুলিশের সহায়তায় ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে চরাঞ্চলজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠে।

রোববার মেঘনা নদীর দড়ি নবীপুর এলাকায় শিশুটিকে গণধর্ষণের পর নদীতে ফেলে দেয় ধর্ষকরা। পরে সাঁতরে গভীর রাতে বিবস্ত্র অবস্থায় বাড়ি ফেরে সে। নির্যাতিত শিশুটির বাড়ি সদর উপজেলার নজরপুর ইউনিয়নের চম্পকনগর গ্রামে। সে স্থানীয় আলিয়া মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী।

নির্যাতিত শিশুর পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবার মৃত্যুর পর চম্পকনগরের মামার বাড়ি থেকে পড়াশোনা করত শিশুটি। রোববার সন্ধ্যায় কালাই গোবিন্দপুর বাজারে কসমেটিক কিনে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে কালাই গোবিন্দপুর নওয়াব আলী স্কুলের পাশ থেকে একই গ্রামের সাদ্দাম মিয়া (২৫), সজীব (২২) ও ফরহাদ (২৩) অপহরণ করে নৌকাযোগে মেঘনা নদীর মাঝখানে নিয়ে যায়।

নৌকায় পালাক্রমে শিশুটিকে ধর্ষণ করে তারা। ধর্ষণের পর শিশুটিকে বিবস্ত্র অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়। পরে কালাই গোবিন্দ্রপুরের ইমানের বাড়িতে শিশুটি আশ্রয় নেয়। খবর পেয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোস্তফা ও স্বজনরা শিশুটিকে উদ্ধার করে।

এদিকে, ধর্ষকরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে উঠে পড়ে লাগে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোস্তফা। সাবেক ইউপি সদস্য কামাল মেম্বার, আলি নূর ও ফজলুকে সঙ্গে নিয়ে নির্যাতিত শিশুর পরিবার ও ধর্ষকদের মধ্যে সালিশের মাধ্যমে ঘটনাটি মীমাংসার উদ্যোগ নেন মোস্তফা।

এরই প্রেক্ষিতে গ্রাম্য সালিশে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় প্রত্যেককে দেড় লাখ টাকা করে মোট সাড়ে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একইসঙ্গে এ ঘটনায় মামলা না করার জন্য শিশুটির পরিবারকে নির্দেশ দেয়া হয়।

তবে জরিমানার টাকা না দেয়ায় বুধবার সকালে নরসিংদী সদর থানা পুলিশের কাছে যায় নির্যাতিত শিশুর পরিবার। কিন্তু বিধিবাম, পুলিশও এ ঘটনায় মামলা না নিয়ে ৫ লাখ টাকায় ঘটনাটি দফারফা করে দেয়।

গণধর্ষণের এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা পুলিশের হস্তক্ষেপে ধামাচাপা দেয়ার খবরে এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সমঝোতা হওয়ায় পুলিশ ও প্রভাবশালীদের ভয়ে এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হয়নি নির্যাতিত শিশু ও তার স্বজনরা। নির্যাতিত শিশুটি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তাকে বাধা দেন মামা ইয়াছিন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিশুটির মামা ইয়াছিন বলেন, যা হয়েছে তা গ্রাম্য মাতব্বর ও পুলিশ সমাধান করে দিয়েছেন। আমরা এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাই না।

টাকার বিনিময়ে গণধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিচ্ছেন কেন এমন প্রশ্ন করা হলে শিশুটির মামা ইয়াছিন কোনো কথা না বলে দৌড়ে পালিয়ে যান।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গ্রাম্য সালিশদার ইউপি সদস্য মোস্তফা বলেন, শিশুটি আমাদের জানিয়েছে, একে একে তিনজন তাকে ধর্ষণ করেছে। এরই প্রেক্ষিতে আমরা অভিযুক্ত তিনজনকে দেড় লাখ টাকা করে জরিমানা করেছিলাম। কিন্তু তারা জরিমানার টাকা না দেয়ায় শিশুটির পরিবার থানায় যায়। সেখানে ওসি সাহেব বিষয়টি সমাধান করে দিয়েছেন। তাই কোনো মামলা হয়নি।

থানা পুুলিশ সূত্রে জানা যায়, সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দুজ্জামান ৫ লাখ টাকায় গণধর্ষণের ঘটনাটি দফারফা করেন। এর মধ্যে নির্যাতিত শিশুর পরিবারকে দেয়া হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। বাকি টাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল) শাহারিয়ার আলম ও থানা পুলিশের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়।

এদিকে, স্থানীয় সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে সরব হওয়ায় বেকায়দায় পড়ে পুলিশ। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি করে বৃহস্পতিবার বিকেল আড়াইটায় নির্যাতিত শিশুর নানিকে ডেকে একটি মামলা নথিভুক্ত করে পুলিশ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দুজ্জামান বলেন, ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়েছে সত্য। কিন্তু পুলিশ সমঝোতা করেছে এটা সত্য নয়। আমরা নির্যাতিত শিশুর পরিবারকে বুঝিয়ে অভিযোগ নিতে বিলম্ব হয়েছে। অভিযোগ পেয়ে মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেছি। বিষয়টি ডিল করেছেন ওসি (তদন্ত) সালাউদ্দিন। তিনি এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন।

পুলিশের মধ্যে আড়াই লাখ টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ওসি সৈয়দুজ্জামান বলেন, আমরা টাকা নিলে মামলা নিলাম কীভাবে?

এ বিষয়ে পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেন, গণধর্ষণের ঘটনাটি কেউ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলে, সে যদি পুলিশও হয় তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।