শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক সঙ্কট : ভারতের কপালে ভাঁজ কেন?

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে; বাড়ছে ভারতের দুশ্চিন্তা। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহেকে সরিয়ে সাবেক সরকার প্রধান রাজাপাকসে নিয়োগ করায় সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে।

নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে চীন-ঘেঁষা বলেই দিল্লির দুশ্চিন্তা বেশি। দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মৈথিরিপালা সিরিসেনা যেভাবে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহেকে সরিয়ে তার জায়গায় বসালেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকে, তাতে দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক তথা সাংবিধানিক সঙ্কট।

সংসদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়েছে। বিক্রমসিংহে এটাকে বলেছেন, অগণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান। এই পটপরিবর্তনে ভারতের কপালে পড়েছে ভাঁজ। কেন ? সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে বরাবরই চীনপন্থী। তার আমলে, অর্থাৎ ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে চীন অনেকটাই শিকড় গাড়তে পেরেছিল শ্রীলঙ্কার মাটিতে। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর অর্থ ঢেলেছিল চীন।

রাজাপাকসে চীনের টাকায় দক্ষিণে নিজের নির্বাচন কেন্দ্রে হামবানটোটা বন্দর তৈরি করতে গিয়ে নাকানি-চুবানি খেয়ে শেষ পর্যন্ত চীনকেই তা বেচে দেন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে রাজাপাকসের ক্ষমতা হারানোর পেছনে নাকি হাত ছিল দিল্লির, এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে বিক্রমসিংহে ছিলেন কিছুটা ভারত-ঘেঁষা। ফলে রাজাপাকসের ক্ষমতায় ফিরে আসাটা দিল্লির পক্ষে দুশ্চিন্তার কারণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজাপাকসেকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনায় এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক অভিঘাত চীনের অনুকূলে যাবে। বেইজিং আবার কলম্বোর অর্থনীতি কব্জা করবে।

চীনের জন্য দরজা খুলে দেবেন রাজাপাকসে। প্রতিকূল অভিঘাতে কলম্বোর উপর দিল্লির প্রভাব শিথিল হবে। ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগ বলছে, শ্রীলঙ্কার ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে চলেছে দিল্লি। ভারত আশা করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে মর্যাদা দেয়া হবে।

দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ত্রিদিব চক্রবর্তী বলেন, এই পরিস্থিতির মূলে আছে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত। কে বেশি ক্ষমতাবান? এটা হচ্ছে প্রথম প্রশ্ন। প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকলে তিনি তা করতে পারেন। আর তা না থাকলে তিনি তা করতে পারেন না। তবে কথা হচ্ছে, ক্ষমতার এই সংঘাতে বাইরের শক্তির ভূমিকা থাকতে পারে। চীনের ভূমিকা থাকতে পারে।

তিনি বলেন, চীন নানাভাবে তার ডানা বিস্তার করে চলেছে এই অঞ্চলে। যেমন- ভুটান, নেপাল এবং দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে। মালদ্বীপের সাম্প্রতিক নির্বাচনে হেরে গেছেন চীনপন্থি আবদুল্লা ইয়ামিন। সেই লোকসান পুষিয়ে নেবে শ্রীলঙ্কায় চীনের মুঠো শক্ত করে। ভুটান সীমান্তে যাকে বলে চিকেন নেকে রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে, যদিও ভুটান এখনো ভারতের উপর নির্ভরশীল। চীনের সঙ্গে এখনো ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।

ভিয়েতনামের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্কে বাধা দিতে চাইছে বেইজিং উল্লেখ করে ত্রিদিব বলেন, পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সমুদ্র নিয়ে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই ইস্যুতে ভারতের হাত মেলানোটাও পছন্দনীয় নয় চীনের। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দুজনেই চীনের একান্ত বশংবদ। অন্যদিকে অপসারিত প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে কিছুটা ভারতপন্থি, এমনটাই মনে করেন তিনি।

অপসারিত প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রনীতিতে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে গেছেন। ভারত ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্কে আনতে চেয়েছেন নতুন গতি। অপসারিত প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে বলেছেন, সংসদের অনুমোদন ছাড়া তাকে অপসারিত করা যায় না৷ সংসদে এখনো তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। সংসদের ২২৫ জন সাংসদের মধ্যে তার দিকে আছেন ১০৬ জন এবং সিরিসেনা আর রাজাপাকসের দিকে আছেন মাত্র ৯৫ জন সাংসদ। সেটা প্রমাণ করার জন্য অবিলম্বে সংসদের অধিবেশন ডাকার দাবি জানিয়েছেন তিনি। সংসদের স্পিকারও বলেছেন একই কথা। অবিলম্বে সংসদের অধিবেশন ডাকা দরকার, যদি চলতি সংঘাতের মীমাংসা করতে হয়।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা যদি অধিবেশন না ডেকে ঝুলিয়ে রাখেন, তাহলে সন্দেহ ঘনীভূত হবে। দলে টানার জন্য রাজাপাকসে সাংসদদের টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করছেন। তাকে মদত দিচ্ছে চীন। সংসদের অধিবেশন ডাকার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। চাপ আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকেও।

বিক্রমাসিংহের অনুসারী জয়সূর্য হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এই বলে যে, সংসদের অধিবেশন ডাকা না হলে আমরা পথে নামবো। পথে নামলে রক্তগঙ্গা বইবে। অন্যদিকে রাজাপাকসের নিয়োগে চীন খুশি। নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট। মোটকথা শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতিতে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় চীন আর ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াবে। ফলে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিতে ভারত রয়েছে অস্বস্তিতে। ডিডব্লিউ।