যে ৫ কারণে হুয়াওয়েকে কোণঠাসা করল পশ্চিমা বিশ্ব
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ে বেশ বিপদেই পড়েছে। হুয়াওয়ের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে কিছু সেবার আর কোনো আপডেট ভার্সন দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে গুগল। ফলে হুয়াওয়ের নতুন স্মার্টফোনগুলোতে অনেক অ্যাপ আর ব্যবহার করা যাবে না।
কিন্তু কী কারণে হুয়াওয়েকে নিয়ে এতটা চিন্তিত পশ্চিমা বিশ্ব? বিশ্লেষকদের মতে এমন কিছু কারণ জানাচ্ছে বিবিসি বাংলা।
বিশ্বব্যাপী হুয়াওয়ে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি স্মার্টফোনের মাধ্যমে। কিন্তু আরও বহু রকম যোগাযোগ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ইকুইপমেন্ট তৈরি করে আছে তাদের।
বিবিসি জানায়, হুয়াওয়ে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে নাও পারে, তারপরও বিশ্বজুড়ে কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের ৪০ হতে ৬০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করবে হুয়াওয়ে। এক দশকেই হুয়াওয়ের বিশাল উত্থান ঘটে। আয় করে শত কোটি মার্কিন ডলারের রাজস্ব।
ফাইভ-জি: গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে সংশয়
ফাইভ-জি নেটওয়ার্ককে মোবাইল টেলিফোনের ক্ষেত্রে পরবর্তী বিপ্লব হিসাবে ধরা হয়। এই নেটওয়ার্ক বসানোর জন্য অনেক দেশের সঙ্গেই আলোচনা চালাচ্ছে হুয়াওয়ে।
এই নতুন নেটওয়ার্ক এত দ্রুতগতির হবে যে বহু নতুন কাজে ও প্রজেক্টে এটি ব্যবহার করা হবে । যেমন চালকবিহীন গাড়ি চালানোর কাজে ব্যবহার হবে এই ফাইভ জি।
এখন হুয়াওয়ে যদি কোনো দেশের ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে চীন ওই দেশের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে পারবে বলে দাবি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর। তারা চাইলে এই ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে আদান-প্রদান করা বার্তা পড়তে পারবে, চাইলে নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিতে পারবে বা সেখানে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের আগেই যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা দেশগুলোকে হুয়াওয়ের সঙ্গে ব্যবসা না করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
‘ফাইভ আই’স’ নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা,অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড পাঁচটি দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ে খুবই ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আছে। যার বেশির ভাগটাই করা হয় ইলেকট্রনিক উপায়ে।
ফলে যুক্তরাষ্ট্র হুঁশিয়ারি দেয় যে, এই ৫ দেশের কোনো দেশ যদি হুয়াওয়ের নেটওয়ার্ক তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইনফরমেশন সিস্টেমে বসায়, তাহলে সেই দেশের সঙ্গে ওয়াশিংটন আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করবে না।
যদিও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ হুয়াওয়ের পক্ষ থেকে বারবার অস্বীকার করা হয়েছে।
হুয়াওয়ে আরও বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে তাদের নিষিদ্ধ করা হলে মার্কিন ভোক্তাদেরই স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। কারণ এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে হুয়াওয়ের বিকল্প হিসাবে তার চেয়ে অনুন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে এবং ফাইভ-জি প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়বে।
‘প্রযুক্তি গুপ্তচরবৃত্তি’কে যুক্তরাষ্ট্র এমন ভয় পাওয়ার কারণ হচ্ছে, বছরের পর বছর তারা নিজেরাই এ রকম কাজ করেছে। দেশটির সাবেক গোয়েন্দা কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস হওয়া তথ্যে দেখা যায়, কীভাবে মার্কিন নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বড় বড় মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির নেটওয়ার্ক হ্যাক করে তথ্য চুরি করত। এর মধ্যে গুগল এবং ইয়াহুর মতো কোম্পানি পর্যন্ত আছে।
কাজেই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীনের কোম্পানিটিকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ যুক্তরাষ্ট্রের।
রোবট এবং অস্ত্র কেলেঙ্কারি
হুয়াওয়ের এক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, জার্মান কোম্পানি টি-মোবাইলের ল্যাব থেকে একটি রোবটের হাত চুরি করে আনেন তিনি।
তবে এই প্রকৌশলীর দাবি, এটি চুরি ছিল না, দুর্ঘটনাবশত ব্যাপারটি ঘটেছে।
টি-মোবাইলের সঙ্গে তখন হুয়াওয়ের পার্টনারশিপ ছিল। ওই প্রকৌশলী টি-মোবাইলের ডিজাইন ল্যাবে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি রোবটের হাত ব্যবহার করে স্মার্টফোনের স্ক্রিন পরীক্ষা করা হয়। এই যন্ত্রটি দুর্ঘটনাবশত তার ব্যাগের মধ্যে পড়ে যায়। যখন তিনি ল্যাব থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন বিষয়টি খেয়াল করেননি।
যদিও জার্মান কোম্পানিটি তার এই কথা বিশ্বাস করেনি। এরপর দুই কোম্পানির মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে যায়।
নতুন কিছু ই-মেইল ফাঁস হওয়ার পর এই কেলেঙ্কারি আবার আলোচনায় উঠে আসে। চীনে তার ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার নির্দেশেই ওই কাজ করেছিলেন প্রকৌশলী, এমনটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে গত বছর যে কানাডায় হুয়াওয়ের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা মেং ওয়ানঝুকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার একটি কারণ এটি।
ইরানের সঙ্গে গোপন ব্যবসা
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ভেঙে গোপনে ইরানে ব্যবসা চালানোর অভিযোগ আছে হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে। ইরানের সঙ্গে কোনো গোপন আঁতাতের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন ওয়ানঝু।
ইরানের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক লেন-লেনদেনের অনেক কিছুর ব্যাপারে তিনি ব্যাংকগুলোকে এবং মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে মিথ্যে কথা বলেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
ওয়ানঝু হচ্ছেন হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতার কন্যা। কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন তিনি। যদি তাকে বিচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয় এবং তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে ৩০ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে তার।
স্মার্টফোনের ভাঙা স্ক্রিন এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে তদন্তাধীন আরও কিছু অভিযোগ হচ্ছে, তারা পরীক্ষা করে দেখার নামে ধার নেওয়া একটি স্মার্টফোনের স্ক্রিনের নমুনা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে পাচার করে দিয়েছিল।
মোবাইল ফোনের স্ক্রিন খুব সহজেই ভেঙে যায়। কাজেই কোনোভাবেই ভাঙবে না এমন একটি স্ক্রিন তৈরি করা গেলে, সেটি যে কোনো প্রযুক্তি কোম্পানির জন্যই একটি বিরাট আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে আখান সেমিকন্ডাক্টার নামের একটি কোম্পানি এ রকম একটি কাচ তৈরি করে হুয়াওয়েকে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। হিরের প্রলেপ দেওয়া কাচের স্ক্রিনটি তারা হুয়াওয়েকে দেয়। সেটি যখন কয়েক মাস পর ফেরত আসে, দেখা গেল সেটি ভাঙা। ব্লুমবার্গের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও হুয়াওয়ে এই অভিযোগও অস্বীকার করছে।
তবে এত কিছুর পরও বিশ্বের প্রযুক্তি জগতে হুয়াওয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি হিসাবে রয়েই যাবে। ইতিমধ্যে নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম বাজারে ঘোষণা দিয়েছে হুয়াওয়ে।
এ ছাড়া আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক দেশেই হুয়াওয়ের প্রযুক্তি ও পণ্যের দাম ইউরোপ এবং আমেরিকার প্রযুক্তির চেয়ে কম। কাজেই এসব দেশে হুয়াওয়ের ব্যবসা বাড়তেই থাকবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন