আন্দোলন শেষ, নিয়ম মানাও শেষ : সড়কে ফের নৈরাজ্য

সরকারের আশ্বাসে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফিরলেও শৃঙ্খলা ফেরেনি রাজধানীর সড়কে। সড়কে যানবাহনচালক এবং পথচারীদের নিয়ম অমান্য আগের মতোই চলছে। পুলিশ বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বিশেষ অভিযান চালালেও সড়কে নৈরাজ্য একটুও কমেনি।

গতকাল রাজধানীর ছয়টি ব্যস্ত বাসস্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বাসচালকেরা যত্রতত্র যাত্রী নামাচ্ছেন-ওঠাচ্ছেন। একই পথের ভিন্ন কোম্পানির বাসের মধ্যে যাত্রী তোলা নিয়ে রেষারেষি হচ্ছে। বাসের পাদানিতেও অতিরিক্ত যাত্রী। আইন না মেনে উল্টো পথে গাড়ি চালানো থেমে নেই। পদচারী-সেতু ব্যবহার না করে পথচারীরা যত্রতত্র রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। মুঠোফোন ব্যবহার করছেন চালকেরা।

পুলিশের বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ এবং বিআরটিএর বিশেষ অভিযানের কারণে গতকাল সড়কে যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যাও ছিল কম। ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের যানবাহনের নিবন্ধন, লাইসেন্স, ফিটনেস, বিমার কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ে বিশেষ অভিযান চালানো হয়। ফলে যাত্রীরা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়েও বাসে উঠতে পারেননি।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে পুলিশ নৈতিক ভিত্তি পেয়েছে। সব জায়গায় পুলিশ হাত দিতে পারছে। বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে জনগণের মধ্যেও আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে উঠতে হবে।

মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় দেখা যায়, বাসের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা সড়কের মাঝামাঝি চলে এসেছেন। একটি বাস এলে যাত্রীরা তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। বাসচালকেরা সড়কের মাঝখানেই বাস থামিয়ে যাত্রী নামাচ্ছেন, ওঠাচ্ছেন। পেছনে অন্য বাস, গাড়ি অনবরত হর্ন দিয়ে যাচ্ছে। আয়াত পরিবহনের একটি বাসকে দেখা যায় চলন্ত অবস্থাতেই যাত্রীদের নামাচ্ছে, আবার চলন্ত বাসেই যাত্রীরা লাফিয়ে উঠছেন। এর মধ্যে পেছনে এসে দাঁড়ায় ল্যাম্পস পরিবহনের একটি বাস। দুটি বাসের চালকের সহকারীরা ‘ফার্মগেট, ফার্মগেট’ বলে যাত্রী তুলছেন। ল্যাম্পস পরিবহনের চালক বিপজ্জনকভাবে আয়াত পরিবহনের বাসটি ওভারটেক করেন। আয়াত পরিবহনের সামনে এসে কয়েকজন যাত্রী তুলেই দ্রুতগতিতে চলে যায় ল্যাম্পস পরিবহনের বাসটি।

বাসের অপেক্ষায় থাকা যাত্রী আব্বাস উদ্দিন বলেন, ‘বাস না থামলে লোকজন কী করবে? বাধ্য হয়েই লাফিয়ে ওঠা লাগছে। যাত্রীদের দাঁড়ানোর জন্য নির্ধারিত কোনো জায়গা বা স্টপেজ নাই। তাই সবাই সড়কের ওপরেই দাঁড়াচ্ছে।’

মিরপুর ১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পদচারী-সেতুর নিচে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন যাত্রীরা। অথচ বাস দাঁড়ানোর নির্ধারিত জায়গা এর থেকে কিছুটা সামনে। বাসচালকেরা এসে পদচারী-সেতুর নিচে গতি কিছুটা কমিয়ে চলন্ত বাসেই যাত্রী তুলছেন। কোনো বাসই নির্ধারিত স্থানে গিয়ে থামছে না।

মহাখালী এলাকায় দেখা যায়, স্কাই লাইন পরিবহনের একটি বাস চলন্ত অবস্থায় সড়কের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী নামাচ্ছে। কয়েকজন যাত্রী দৌড়ে এসে ওই চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠছেন। যাত্রীরা যাতে পড়ে না যায় সে জন্য চালকেরা সহকারী টেনে তুলছেন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির অন্যতম ছিল বাসে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই না করা। গতকাল অধিকাংশ বাস ছিল যাত্রীতে বোঝাই। বাসগুলোর পাদানিতে ও গেটের বাইরেও যাত্রীদের ঝুলতে দেখা যায়। অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হলেও এসব বাসে আদায় করা হয় সিটিং সার্ভিসের ভাড়া।

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ফার্মগেট পদচারী-সেতুর নিচে উল্টো পথে আসা গাড়ি ও মোটরসাইকেল আটকাচ্ছিলেন চারজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য। এ সময় বিজ্ঞান কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে উল্টো পথে একটি মাইক্রোবাস আসে। মাইক্রোবাসের সামনে লাগানো কাগজে লেখা ছিল ‘সরকারি বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাইস্কুল, ৩৮ তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত’। মাইক্রোবাসের চালকের পাশের আসনে একজন পুলিশ সদস্য বসা।

দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট আবদুল জলিল মাইক্রোবাসটি থামিয়ে প্রথমেই সেটির ছবি তোলেন। সার্জেন্ট চালককে গাড়িটি ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য করলেও কোনো জরিমানা বা মামলা করেননি। এ সময় উল্টো পথে আসা একাধিক মোটরসাইকেলচালককেও আটকে দেন ট্রাফিক সদস্যরা।

ফার্মগেট ট্রাফিক পুলিশ বক্স থেকে মাইকে পথচারী ও যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। পথচারীদের যত্রতত্র পারাপার না হতে আহ্বান জানানো হচ্ছে পুলিশের পক্ষ থেকে। দেখা যায়, পুলিশ বক্সের ঠিক সামনে দিয়েই লোকজন ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। দুই পাশেই লোকজন সড়ক পার হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। চলন্ত গাড়ির মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পেলেই দৌড় দিচ্ছেন। অথচ এর ২৫-৩০ গজ সামনেই পদচারী-সেতু।

দৌড়ে পার হওয়া পথচারীদের মধ্যে স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরিহিত শিক্ষার্থীও রয়েছে। ফার্মগেটে দৌড়ে সড়ক পার হওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জুলকারনাইন বলেন, ‘সময় বাঁচাতে নিচ দিয়ে পার হলাম। কাজটি ঠিক না সেটি বুঝতে পারছি। অভ্যাস হয়ে গেছে।’

মিরপুর ১ নম্বর গোলচত্বর পদচারী-সেতুর নিচ দিয়ে হরদম লোকজন পার হচ্ছেন। গতকাল পদচারী-সেতুর নিচে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। পদচারী-সেতু ব্যবহার না করায় পাঁচজন পথচারীকে জরিমানা করা হয়। দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ২০ ফুট দূর দিয়েই লোকজন পার হচ্ছেন। সড়ক বিভাজকের ওপরে উঠে আবার অনেকক্ষণ দাঁড়াচ্ছেন। গাড়ির গতি কিছুটা কমলে চলন্ত গাড়ির সামনে হাত উঁচিয়ে দৌড়ে বাকি অংশ পার হচ্ছেন।

তবে বিপরীত চিত্র দেখা যায়, মহাখালী এলাকায়। সেখানে স্কাউট দলের প্রায় ১৫ জন সদস্য পথচারীদের পদচারী-সেতু ছাড়া সড়ক পার হতে দিচ্ছেন না। পথচারীরা সারি দিয়ে পদচারী-সেতুতে উঠছেন ও নামছেন। অধিকাংশ পথচারী স্কাউট সদস্যদের সহযোগিতা করলেও কেউ কেউ নিচ দিয়ে পার হতে না পেরে স্কাউট সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

বাস, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলচালকেরা আগের মতো চলন্ত অবস্থাতেই মুঠোফোন ব্যবহার করছিলেন। কারওয়ান বাজার মোড়ে দেখা যায়, ওয়েলকাম পরিবহনের এক বাসচালক এক হাতে মোবাইল ফোন কানে ধরে রেখেছেন, অন্য হাতে স্টিয়ারিং সামলাচ্ছেন। মহাখালী এলাকায় দেখা যায়, মোটরসাইকেলচালক হেলমেটের ভেতরে মোবাইল ফোন ঢুকিয়ে কথা বলতে বলতে চালাচ্ছেন।

ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও চালকের বিরুদ্ধে পুলিশ গতকাল সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত মামলা করেছে ৪ হাজার ৬০৭ টি। জরিমানা করা হয় ২২ লাখ টাকা। বিআরটিএর তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর আওতায় মামলা করেছে ৩৫ টি। জরিমানা করা হয়েছে ৭১ হাজার টাকা।

জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, পুরোনো ব্যবস্থা রেখে আইন প্রণয়ন করলে হবে না। যাঁরা সড়ক খাতে শৃঙ্খলা আনার দায়িত্বে আছেন, তাঁদেরও আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। বাস ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে হলে ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি’ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। পথচারীরা মোড় দিয়ে সড়ক পার হবেন-এটাই বৈজ্ঞানিক এবং প্রচলিত নিয়ম। বাংলাদেশেও সিগন্যাল-ব্যবস্থা কার্যকর করে মোড় দিয়ে সড়ক পারাপারের ব্যবস্থা করতে হবে।