ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু, আতঙ্কে বাংলাদেশিরা

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে হামলা শুরু করে রাশিয়া। ইউক্রেনের রাজধানী কিভ, খারকোভ, ওডেসাসহ বিভিন্ন শহরে একের পর এক হামলা চালায় রাশিয়া। হামলার বিকট শব্দ, আগুন আর ধোঁয়ায় আতঙ্কিত হয়েছেন অনেকেই। বাদ নেই বাংলাদেশিরাও।

সোয়া ৪ কোটি জনসংখ্যার দেশ ইউক্রেন। সেখানে বসবাস করে এক থেকে দেড় হাজারের মত বাংলাদেশি। কেউ কেউ ব্যবসা করেন, আবার অনেকে গেছেন পড়তে। ইউক্রেনের এই উত্তপ্ত অবস্থায় বাংলাদেশিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

ইউক্রেনে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী মাহবুব গণমাধ্যমকে জানান, ‘একটা কাজে আমি দেশে গিয়েছিলাম। গতকাল (সোমবার) বিকেলে কিয়েভ ফিরেছি। বাংলাদেশে থাকার সময় মিডিয়ায় নানা খবর দেখে বেশ দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। এখানে চোখের দেখায় সব মোটামুটি স্বাভাবিক বলে মনে হয়, গণপরিবহনও চলছে। তবে সবার মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা চলছে, দুশ্চিন্তা আছে।’

কিয়েভে পোল্যান্ডের দূতাবাসও বিদেশিদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে জানান মাহবুব।

পোলিশ দূতাবাসের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ‘পোলিশ অথরিটি আমাদের জানিয়েছে যদি সে রকম জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে ইউক্রেনে যারা বিদেশি আছেন, তাদের জন্য হয়ত সহজে পোল্যান্ড চলে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা হবে। এমন সিদ্ধান্ত তারা নিচ্ছেন বলে আমাদের জানানো হয়েছে।’

এ বিষয়ে পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ইউক্রেনে বসবাসরত প্রায় পাঁচশ বাংলাদেশি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং তারা চলে যেতে চাইলে তাদের কী ধরনের সহায়তা দেওয়া যাবে, তা নিয়ে তারা ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

পোল্যান্ড সরকার ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্ত খুলে দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পোল্যান্ড সরকার এক ব্রিফিংয়ে আমাদের জানিয়েছে, ইউক্রেনে থাকা তৃতীয় দেশের নাগরিকরা সেদেশ ছাড়তে চাইলে, পোল্যান্ড ১৫ দিনের জন্য তাদের ট্রানজিটে থাকার অনুমতি দেবে।’

এছাড়া ইউক্রেনে বসবাসরত আরেক ব্যবসায়ী খালেদ হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ইউক্রেনের জনগণ রাশিয়ার হাতে বিভিন্নভাবে শোষিত। কিন্তু ইউক্রেন ও রাশিয়া কোনোদেশের জনগণই যুদ্ধ চায় না।

বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশিসহ সকল অভিবাসী কমিউনিটিই আতঙ্কিত। আমি কিয়েভে বসবাসরত প্রায় ১০০ বাংলাদেশিকে চিনি যারা ছোটখাটো ব্যবসা কিংবা চাকরি করেন। সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

এদিকে ইউক্রেনের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ইউক্রেনে বসবাসকারী ব্যক্তিরা বাংলাদেশে ফিরতে চান কি না সেটি তাদের ব্যাপার।

তবে ইউক্রেনে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা যদি নিজ দেশে ফেরার পরিকল্পনা করেন তাহলে ইউক্রেনের প্রতিবেশি দেশগুলোর কাছে সহায়তা চাওয়াসহ বাংলাদেশ সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে তিনি নিশ্চয়তা দেন।

যখনই কোনো দেশ বা অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, আমরা নাগরিকদের সতর্ক করি ও সাবধানে থাকার পরামর্শ দিই, বলেন তিনি।

২০১৫ সালে ইয়েমেনে যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইয়েমেন যখন যুদ্ধবিদ্ধস্ত, তখন অনেক বাঙালি সফলভাবে দেশে ফিরেন। কিন্তু এর আগে আমরা লিবিয়ায় দেখেছি প্রজ্ঞাপন জারির পরেও অনেকে আসেননি। সুতরাং এটি তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে কেউ আসতে চাইলে বাংলাদেশ সহায়তা করবে।

এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রায় ২০ হাজার নাগরিক ইউক্রেনে আটকে রয়েছে। এসব ভারতীয়দের ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরু হয়ে যাওয়ার পরই আকাশপথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান সেখানে অবতরণই করতে পারেনি। যাত্রী ছাড়াই ফিরে আসতে হয়েছে দিল্লিতে। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ইউক্রেনে ‘সামরিক অভিযান’ শুরু করে রুশ বাহিনী। ইউক্রেন দাবি করেছে- রাশিয়া পুরোদমে যুদ্ধ শুরু করেছে। এরপর ইউক্রেনের বড় বড় কয়েকটি শহরে সামরিক স্থাপনায় রুশ বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইউক্রেনের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সামরিক শাসন জারির আহ্বান জানান, এরপর এক মাসের জরুরি অবস্থা জারি করে ইউক্রেন।

এদিকে বিশ্বনেতাদের প্রতি রাশিয়ার ওপর কঠোর বিধি নিষেধ আরোপের আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেন। সেই ধারাবাহিকতায় রুশ সেনাদের অভিযান থামানোর আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। এ নিয়ে জরুরি বৈঠকেও বসেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এছাড়া রাশিয়ার অভিযানে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

পূর্ব ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার লাখো সেনা মোতায়েন নিয়ে উত্তেজনা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। গত সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) পূর্ব ইউক্রেনকে স্বাধীন ঘোষণার পর রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান ছাড়াও ইউরোপের ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে। রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস পাইপ লাইন নর্ড স্ট্রিম টুতেও কঠোর নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়েছে ইউরোপ। আপাতত প্রকল্প স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

রাশিয়ার আগ্রাসী ভূমিকার ওপর পরবর্তী কঠোর পদক্ষেপ নির্ভর করছে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসছেন রাশিয়ার ৩৫১ আইনপ্রণেতা। ইইউর ব্যাংকগুলোতে থাকা রাশিয়ার তহবিল আটকে দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে গণমাধ্যম।