ইনজুরিতে সাকিব : জিম্বাবুয়ে সিরিজে টেস্ট অধিনায়ক কে?

জীবনের নানা শাখা-প্রশাখার মতো ক্রিকেটেও ওঠানামা আর পালাবদল হয় প্রতিনিয়ত। ক্রিকেটেও কারো দিনকাল ও সময় এক রকম কাটে না, থাকে না। এই পৌষমাস, সাফল্যের বৃহস্পতি তুঙ্গে তো কখনও কখনও সর্বনাশও নেমে আসে। শনির দশা হয় সঙ্গী।

কবে, কখন কার কি অবস্থা হয়, পালাবদলের পালায় কার সু-সময়ে কখন যে শনি ভর করে কেউ তা আগাম বলতে পারেন না। অনুমানও করা সম্ভব হয় না।

দেশের ক্রিকেটের দুই জনপ্রিয় তারকা এবং ‘পঞ্চ পান্ডবের’ দুই মূল স্তম্ভ তামিম ইকবাল এবং সাকিব আল হাসান যে প্রায় একসঙ্গে ইনজুরির ভয়াল থাবায় আক্রান্ত হয়ে মাঠের বাইরে ছিটকে পড়বেন, আরব আমিরাতের দুবাইতে এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের সাথে ঘটনাবহুল ও রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে খেলতে পারবেন না, তা কে ভেবেছিলেন?

সেটাই শেষ নয়। এরপর অক্টোবর-নভেম্বরে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজেও সাকিব-তামিমকে পাবে না টিম বাংলাদেশ। ওই দুই শীর্ষ তারকা এবং দুই অপরিহার্য সদস্য একসঙ্গে খেলতে পারবেন না, তাইবা কে জানতো? কেউ হয়ত কল্পনাও করেননি দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পূর্ণাঙ্গ সিরিজে তামিম ও সাকিবের সার্ভিস পাবে না দল। তাদের ছাড়াই খেলতে হবে।

কেউ আগাম না ভাবলেও কঠিন সত্য হলো, এখন সেটাই বড় বাস্তব। দু’জনার ইনজুরির সর্বশেষ যে অবস্থা, তাতে মোটামুটি নিশ্চিত যে এ বছর অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে জিম্বাবুইয়ানদের বিপক্ষে টাইগারদের যে টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সিরিজ হবে তাতে খেলা হবে না সাকিব ও তামিমের।

এখন সাকিবের বাঁ-হাতের কনিষ্ঠা আঙুলের যে অবস্থা তাতে, সাকিবের ভালো হয়ে মাঠে ফিরতে ফিরতে আড়াই থেকে তিন মাস। তার মানে ডিসেম্বরের আগে তার সুস্থ হবার সম্ভাবনা খুব কম।

অন্যদিকে সবে লন্ডনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখিয়ে ও চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরা তামিম ডাক্তারের উদ্ধৃতি দিয়ে কাল রাতেই জানিয়েছেন অন্তত সাত থেকে আট সপ্তাহর আগে তার বাঁ হাতের কব্জির ফ্র্যাকচার ভালো হবার সম্ভাবনা খুব কম। এখন থেকে আট সপ্তাহ মানে অক্টোবর ও নভেম্বর- দুই মাস খেলতে পারবেন না তামিমও। কাজেই ১৫ নভেম্বর টেস্ট দিয়ে জিম্বাবুয়ের সাথে যে সিরিজ শেষ হবে- তাতে মাঠে নামা সম্ভব নয়।

জিম্বাবুয়ের সাথে পারফরমার ক্রিকেটার, ওপেনার তামিম এবং এবং অলরাউন্ডার সাকিবের সাথে আরও একটা বড় শূন্যতা দেখা দেবে। বাংলাদেশ দল মিস করবে টেস্ট ক্যাপ্টেন সাকিবকে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে তামিম ও সাকিবের বিকল্প পারফরমার খোঁজার কাজ শুরু করে দিয়েছেন নির্বাচকরা; কিন্তু টেস্টে পারফরমার সাকিবের পাশাপাশি একজন অধিনায়কও খুঁজতে হচ্ছে। এখনই টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক এবং বোর্ড কর্মকর্তাদের ভাবনায় চলে এসেছে টেস্ট ক্যাপ্টেন ঠিক করা।

ক্রিকেটপাড়া, ভক্ত- অনুরাগি মহলে কৌতূহলী প্রশ্ন, ‘আচ্ছা সাকিব তো খেলতে পারবেন না, তাহলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের জায়গায় অধিনায়কত্ব করবেন কে?’

কি আশ্চর্য্য, এ বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও এমন পরিস্থিতির উদ্রেক ঘটেছিল। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ছিলেন না সাকিব। প্রথম টেস্টে তামিম-সাকিব দু’জনই খেলতে পারেননি। সাকিবের বদলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। লঙ্কানদের বিপক্ষে টেস্টের পাশাপাশি টি-টোয়েন্টি সিরিজেও টিম বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

খুব স্বাভাবিক সমীকরণে তাই তার নামই উঠে আসছে সবার আগে। চারিদিকে গুঞ্জন, কৌতূহলী প্রশ্ন, ‘এবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টেও সেই মাহমুদউল্লাহই অধিনায়ক? নাকি বোর্ড নতুন কারো কথা ভাবছে?’

কেউ কেউ হয়ত তেমনি ভাবছেন। বাংলাদেশ ভক্ত-সমর্থকদের একাংশের ধারণা, এ বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার সাথে যখন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন, এবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাকিবের অনুপস্থিতিতে তিনিই নেতৃত্ব দেবেন হয়ত বা।

ভিতরের খবর কিন্তু ভিন্ন। মাহমুদউল্লাহ নন, এবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে আবার দল পরিচালনার দায়িত্ব বর্তাতে পারে মুশফিকুর রহীমের কাঁধে।

বোর্ডের অভ্যন্তরে খোঁজ নিয়ে এবং শীর্ষ কর্তাদের সাথে কথা বলে তেমন ইঙ্গিতই মিলেছে। যদিও এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ইস্যুতে কেউ আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি প্রধান আকরাম খান, বোর্ডের নির্ধারনী মহলের অন্যতম সদস্য জালাল ইউনুস এবং প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর মত ব্যক্তিত্বও এ নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে রাজি হননি।

তবে প্রত্যেকে স্বীকার করেছেন, সাকিব যেহেতু খেলতে পারবে না, তার বদলে টেস্ট অধিনায়ক নির্বাচন করতেই হবে। আর অধিনায়ক মনোনয়ন যেহেতু বোর্ড করে, এটা পরিচালক পর্ষদের এখতিয়ার তাই হয়ত বোর্ডের সর্বোচ্চ ফোরামেই তা নির্ধারিত হবে।’

তবে যেহেতু আগে ওয়ানডে সিরিজ। তারপর টেস্ট সিরিজ শুরু হতে এখনও এক মাস বাকি (প্রথম টেস্ট আগামী ৩ নভেম্বর সিলেটে শুরু হবে)। তাই টেস্ট ক্যাপ্টেন মনোনয়নের জন্য হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে।

তাই বোর্ড যে তড়িঘড়ি করে আজ-কালের মধ্যেই টেস্ট অধিনায়ক চূড়ান্ত করে ফেলবে- এমন নয়। জানা গেছে বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসান পাপন আজ-কালের মধ্যে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। তিনি ফেরার পরই হয়ত টেস্ট অধিনায়ক নির্বাচনের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। সেখানে সবার মতামতের ভিত্তিতে টেস্ট ক্যাপ্টেন চূড়ান্ত হলেও তাতে বোর্ড প্রধানের মত পাবে সর্বাধিক গুরুত্ব। তার পছন্দই শেষ কথা বলে বিবেচিত হবে।

এ বছর শুরুর দিকে শ্রীলঙ্কার সাথে টেস্ট সিরিজে ফল ভালো হয়নি। চট্টগ্রামে কোনরকমে ড্র করা সম্ভব হলেও ঢাকায় ন্যাক্কারজনকভাবে ইনিংস পরাজয় ঘটে। টিম পারফরমেন্স খারাপ হওয়াই শুধু নয়। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর পারফরমেন্সও ভালো ছিল না।

কাজেই এমন একজনকে খোঁজা হচ্ছে যিনি পারফরমার ভালো, দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন এমন এবং পারফরমেন্স পুরো দলকে চাঙ্গা ও উজ্জীবিত করতে পারে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, পরিসংখ্যানকে মানদণ্ড ধরলে মুশফিক সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশের সফলতমত টেস্ট অধিনায়ক। এ দেশের টেস্ট ইতিহাসের তিন তিনটি বড়, অবিস্মরনীয় ও ঐতিহাসিক অর্জন তার নেতৃত্বেই।

মুশফিকের অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো বিশ্বশক্তির বিপক্ষে টেস্ট জিতেছে। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় লঙ্কানদের বিপক্ষে শততম টেস্টের অবিস্মরনীয় ও ঐতিহাসিক জয়ের মিশনেও মুশফিকুর রহীমই ছিলেন অধিনায়ক।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, টেস্ট অধিনায়কের আর্মব্যাজ পরে ব্যাটসম্যান মুশফিকও টেস্টে অনেক বেশি সফল। তার টেস্ট ক্যারিয়ারের মোট রানের ৬০ ভাগেরও বেশি করেছেন অধিনায়ক হয়ে খেলার সময়। অধিনায়কত্ব ছাড়া মুশফিক ২৮ টেস্টে ৫৫ ইনিংসে তিনবার অপরাজিত থেকে করেছেন ১৩৭৮ রান। শতরান মাত্র একটি। অর্ধশতক সাতটি। গড় ২৬.৫০।

অন্যদিকে টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকের পরিসংখ্যান অনেক সমৃদ্ধ। তার টেস্ট রান; ৩৪ টেস্টে ৬১ ইনিংস পাঁচবার নটআউট সহ ২৩২১। একটি ডাবল সেঞ্চুরিসহ সর্বোচ্চ ২০০। গড় অনেক বেশি; ৪১.৪৪। মোট পাঁচ শতকের চারটি অধিনায়ক হিসেবেই। ১২টি হাফ সেঞ্চুরিও আছে।

অন্যদিকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের টেস্ট পরিস্যখ্যান ওয়ানডের মতো উজ্জ্বল নয়। ৩৯ টেস্টে (৭৪ ইনিংসে চারবার নটআউট থেকে) রান ২০৮৪। সর্বোাচ্চ ১১৫। গড় ২৯.৭৭। শতরান মাত্র একটি। হাফ সেঞ্চুরি ১৫টি।

শতরান পেয়ে গিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের পঞ্চম টেস্টেই; কিন্তু ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শতরান করার পর ৩৪ টেস্টে আর শতরান নেই। এ বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথমবার টেস্টে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে রিয়াদ চার ইনিংসে করেছেন (২৮*+৮৩*+১৭+৬) ১৩৪ রান।

টেস্টে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতে তেমন উজ্জ্বল না রিয়াদ। ৩৯ টেস্টে উইকেট পেয়েছেন ৪০টি। সেরা বোলিং ৫/৫১। ম্যাচসেরা ফিগার ৮/১১০। সেটাও ৯ বছর আগে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংসটাউনে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টে; কিন্তু অভিষেকে বল হাতে নৈপুণ্য দেখানোর পর রিয়াদ আর কখনও তারপর টেস্টে পাঁচ উইকেট বহুদুরে চার উইকেটও পাননি।

কাজেই পারফরমেন্সের বিচারের মাহমুদউল্লাহর চেয়ে মুশফিক অনেক এগিয়ে। কাজেই মাশরাফি ও সাকিবের মতো সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার পারফরমারকেই যদি সাকিবের বদলে টেস্ট ক্যাপ্টেন করা হয়, তাহলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ নন, প্রথম পছন্দ হবেন মুশফিক। তাইতো ভিতরে ভিতরে তার কথাই ভাবা হচ্ছে বেশি।

সেই জায়গা এবং ভূমিকায় সাকিব ছাড়া তামিম হতে পারতেন, ভালো বিকল্প। টেস্টে তামিমের পারফরমেন্স বরাবরই ভালো; কিন্তু এবার তো সাকিবের সাথে তামিমও নেই। তাই মাহমুদউল্লাহর বদলে অন্য কারো কথা ভাবা হলে সবার আগে চলে আসছে মুশফিকুর রহীমের নাম।

বোর্ডের ভেতরেও আছে মুশফিকের প্রতি অন্যরকম সহানুভূতি ও ভালো লাগা। আছে পরিশ্রম, অধ্যবসায়, আত্মনিবেদন এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের বিচার বিবেচনায় মাহমুদউল্লাহর চেয়ে টেস্টে মুশফিকই সবচেয়ে ভালো বিকল্প।-সৌজন্যে : জাগোনিউজ।