ইবি ছাত্রীকে নির্যাতন ও বিবস্ত্রের ঘটনায় তিন তদন্ত কমিটি গঠন

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ছাত্রলীগ নেত্রী কর্তৃক ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের অনাবাসিক ছাত্রীকে রাতভর র‍্যাগিং এর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার এইচ এম আলী হাসান সাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্যটি জানা যায়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের বিভাগের ছাত্রী ফুলপরি খাতুন( ভুক্তভোগী) এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা (অভিযুক্ত) কাছ থেকে প্রাপ্ত দুটি অভিযোগের বিষয়ের উপর জরুরি ভিত্তিতে তদন্তপূর্বক একটি প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন।

কমিটিতে আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. রেবা মন্ডলকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটিতে অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে- একাডেমিক শাখার উপ-রেজিস্ট্রার মো. আলীবদ্দীন খান (সদস্য সচিব),প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ড. দেবাশীষ শর্মা (সদস্য), খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন আরা সাথী (সদস্য) এবং সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুর্শিদ আলম (সদস্য)।

উপরিউক্ত কমিটি আগামী ৭ (সাত) কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করবেন।

এদিকে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল কর্তৃপক্ষ ৪ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি দতন্ত কমিটি গঠন করেছে।

উক্ত হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দতন্ত কমিটির জন্য ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. আহসানুল হককে আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য ৩ সদস্য হলেন-হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইসরাত জাহান (সদস্য), ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৌমিতা আক্তার (সদস্য), হলের শাখা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক ( সদস্য সচিব)।

উক্ত কমিটি আগামী ৭ (সাত) কর্মদিবসের মধ্যে প্রভোস্ট বরাবর রিপোর্ট প্রদান করবেন।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগও ৪ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

সন্ধ্যায় ইবি ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত ও নাসিম আহমেদ জয় স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।তারই ধারাবাহিতা হিসেবে র্যাগিং একটি ঘৃণ্য কাজ হিসেবে অবহতি ও বিবেচনা করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারিতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তদন্ত করার স্বার্থে ৪ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কমিটিতে শাখা সহ-সভাপতি মুন্সি কামরুল হাসান অনিককে আহ্বায়ক করা হয়েছে। অন্য তিন সদস্য হলেন- বনি আমিন, রকিবুল ইসলাম ও সাংগঠনিক সভাপতি মোঃ জাকির হোসেন।

ইবি ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ঘটনা যদি সত্য হয় এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে আমরা প্রশাসনের কাছে তার শাস্তির দাবি জানাবো। আমরা সাংগঠনিকভাবেও ব্যবস্থা নেবো।

উল্লেখ্য, র‍্যাগিং এর শিকার ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের নবীন ছাত্রী ফুলপরি লিখিত অভিযোগে করে জানায়, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চান, কারা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে থাকেন। এ সময় আমি হাত তুলি। কিন্তু হলে ওঠার বিষয়টি তাবাসসুমকে না জানানোর কারণে রেগে যান তিনি। এর পর তাকে হলের কক্ষে (প্রজাপতি-২) দেখা করতে বলেন। তবে ওই শিক্ষার্থী দেখা না করায় ১১ ফেব্রুয়ারি ক্লাসে গেলে তাকে বকাঝকা করেন তাবাসসুম।

ওই ছাত্রীর অভিযোগ, এ ঘটনার জেরে ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী হলের গণরুমে (দোয়েল) তাকে ডেকে নেন। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়জন তাকে রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতন করেন। তিনি বলেন, আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল আর এর ফাঁকে ফাঁকে শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছিল। কাপড়ের আলপিন দিয়ে পায়ের ঊরুতে ফুটাচ্ছিল।থাপ্পড়,কিল- ঘুষিও দিয়েছিল।

ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, এ সময় আরেক ছাত্রী মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিওধারণ করে। একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ করা হয়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পা ধরে ক্ষমা চাইলেও তারা কোনো কথা শোনেননি। গণরুমে এ সময় উপস্থিত সাধারণ ছাত্রীরাও কোনো কথা বলেননি।

ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয় এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এমনকি প্রভোস্টের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিষয় লিখে দিয়ে আমাকে বলেছেন, হাসবি আর এগুলা বলবি। সব তারা ভিডিও করে রেখেছে। আপুরা মারার সময় বলছিল, মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।

ভুক্তভোগী আরো বলেন, রাতের কথা কাউকে জানালে ওই ছাত্রীরা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এ কথা কাউকে বললে হল থেকে বের করে দেবে বলে শাসায়। এই কথা বাইরে গেলে ভিডিও ভাইরাল করে দেবে। তারা বলে, তুই হলের প্রভোস্ট স্যারকে বলবি, সব আমার দোষ, এই হলে থাকব না। এসব বলে হল থেকে একেবারে চলে যাবি। এই কথা ১৪ তারিখ বলবি।

ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, অনেকবার ক্ষমা চেয়েছি, কেউ কোনো কথা শোনেনি। রাত সাড়ে ৩টার পর তাঁরা চলে যায়। আমি গণরুমেই ছিলাম। এর পর ১৩ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) সকাল নয়টার দিকে ক্যাম্পাসের সামনে থেকে বাসে উঠে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। আমার শরীর ব্যথা। জ্বর অনুভব করছি। ঠিকমতো খেতে পারছি না। গালের ভেতর কেটে গেছে। সার্বিক বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে আমি প্রক্টর, ছাত্র-উপদেষ্টা ও প্রভোস্টের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। আমি এ ঘটনার বিচার চাই। যারা জড়িত, প্রত্যেকের শাস্তি চাই।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী( অভিযুক্ত) বলেন, অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। ওই মেয়ে মিথ্যা বলছে। হয়তো এক কুচক্রী মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তার ব্যাপারে প্রমাণ দিয়েছি। প্রভোস্ট, ছাত্র উপদেষ্টা ও প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।

অভিযুক্ত অন্যজন হলেন- ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম।
এছাড়াও তাদের সঙ্গী ৭/৮ জন।

এদিকে একই দিনে ছাত্রলীগ নেত্রী অন্তরা ঘটনাটি মিথ্যা দাবি করে ভুক্তভোগীর ও প্রকাশিত সংবাদের বিচারের দাবিতে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।