একবছরে ২২১ কোটি টাকার মামলা, ট্রাফিক পুলিশের ভাগে কত?

চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর রাওয়া ক্লাবের সামনের রাস্তায় একটি গাড়ি থামিয়ে চালকের কাছে কাগজপত্র দেখতে চান কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট। চালক কাগজ দেওয়ার পর সার্জেন্ট তা পরীক্ষা করে দেখছিলেন। এর মধ্যেই এক চীনা নাগরিক ওই গাড়ি থেকে নেমে উত্তেজিত হয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টের দিকে টাকা ছুড়ে মারেন। পাশ থেকে কেউ ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মুহূর্তেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়।

ভিডিওটিতে দেখা যায়, চীনের ওই নাগরিক ট্রাফিক পুলিশকে লক্ষ্য করে বারবার বলছেন, ‘ইউ ওয়ান্ট মানি, আই গিভ ইউ দিস…মানি’ (তুমি টাকা চাচ্ছ, আমি তোমাকে টাকা দিচ্ছি)। এই বলে তিনি টাকা ছুড়ে মারেন এবং অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন। তবে এ ঘটনার তদন্তে সার্জেন্টের কোনো দোষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই চীনা নাগরিক বিনা কারণে মেজাজ হারিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বলে তদন্তে উঠে আসে। পরে ওই চীনা নাগরিক ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে ক্ষমাও চান।

চীনা নাগরিকের ধারণা ছিল ট্রাফিক পুলিশ টাকার জন্য গাড়ির কাগজপত্র চেক করেন। এ কারণে তিনি পুলিশের দিকে টাকা ছুড়ে মেরেছিলেন। শুধু বিদেশি নাগরিক নন, দেশের বেশিরভাগ মানুষও মনে করে ট্রাফিক পুলিশ যত মামলা দেবে তত বেশি তাদের আয় (জরিমানার ভাগ পান)। কিন্তু জনগণের এ ধারণাটি ভুল বলছে ট্রাফিক বিভাগ।

ট্রাফিক বিভাগ বলছে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও মোটরযান আইন যথাযথ বাস্তবায়নে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারী চালক ও গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা-জরিমানা হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। সড়কে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে অকারণেই ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের দোষী হতে হচ্ছে। চালকরা ভাবেন, ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা জরিমানার ভাগের জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেন।

জানা যায়, হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার, ট্রাফিক পুলিশের আদেশ অমান্য করা, বাধা সৃষ্টি ও তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানানো, উল্টো পথে গাড়ি চালানো, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, হেলমেট না পরে মোটরসাইকেল চালানো, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা- এসব অপরাধে মোটরযান আইনে মামলা হয়। এছাড়া গাড়ি চলন্ত অবস্থায় কালো ধোঁয়া বের হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানা করতে পারেন।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সারাদেশে ২০২১ সালে মোটরযান আইনে মোট ৯ লাখ ৫৫ হাজার ৯১২টি মামলা হয়। এসব মামলায় ২২১ কোটি ৭ লাখ ৩১ হাজার ৪১৪ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। ২০২১ সালে সর্বোচ্চ মামলা হয় ডিএমপিতে। মামলার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯১১টি। এসব মামলায় জরিমানা আদায় হয় ৫০ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩০৩ টাকা।

২০২০ সালে সারাদেশে মোটরযান আইনে মোট মামলা হয় ৬ লাখ ১৩ হাজার ১৯টি। এসব মামলায় মোট জরিমানার পরিমাণ ৭৭ কোটি ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ২৫৬ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে মামলার সংখ্যা বেড়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৮৯৩টি। আর জরিমানা আদায় বেড়েছে ১৪৩ কোটি ৭৯ লাখ ৪৫ হাজার ১৫৮ টাকা।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ জানায়, শুধু ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সরকারের কোষাগারে প্রতি মাসে মামলা বাবদ দিচ্ছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আসাদগেট এলাকায় হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন শফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট তাকে থামিয়ে দুই হাজার টাকা দণ্ডের মামলা দেন। দ্বিতীয়বারও একইভাবে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করায় তাকে এই পরিমাণ টাকার মামলা দেন সার্জেন্ট। হেলমেট না পরায় এবং ট্রাফিক আইন অমান্য করায় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ৯২ (১) ধারা মোতাবেক এ মামলা দেওয়া হয়।

ট্রাফিক তেজগাঁও জোনের খেজুর বাগানস্থ বঙ্গবন্ধু চত্বর ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যালে কথা হয় সার্জেন্ট মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, সরকারের অন্যান্য সংস্থা কোনোকিছু উদ্ধার করলে সেখান থেকে ৩০ শতাংশ পায়। সেটা সংশ্লিষ্ট সংস্থা তাদের খরচ বাবদ দেখাতে পারে। কিন্তু ট্রাফিক বিভাগে এমন কিছু নেই। মামলায় যদি ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কমিশন দেওয়া হতো তাহলে আমরা শুধু মামলাই দিয়ে যেতাম। এতে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের মধ্যে মামলা দেওয়ার প্রতিযোগিতা বেড়ে যেত।

তিনি বলেন, অধিকাংশ গাড়িতেই কিছু না কিছু ত্রুটি থাকে। প্রতি একশো গাড়িতে ইচ্ছা করলে অর্ধেকের বেশিকেই মামলা দেওয়া যায়। কিন্তু এভাবে মামলা দিলে সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

ট্রাফিক পুলিশের বেতন আগের তুলনায় বেশ ভালো বাড়িয়েছে সরকার। ফলে মামলার পার্সেন্টেজ নিয়ে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই- যোগ করেন আরিফুল ইসলাম।

মিরপুর ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট আব্দুল হাকিম বলেন, মামলায় আদায় হওয়া অর্থ থেকে সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ সদস্য কিছু পান না। মামলা থেকে আসা অর্থের পুরোটাই ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি সরকারের কোষাগারে জমা হয়। ‘কত পান’- এই প্রশ্নটা চাকরিজীবনে যে কতবার শুনেছি তা গুনে শেষ করা যাবে না। ট্রাফিক পুলিশ মামলা দিলে কমিশন বা পার্সেন্টেজ পায়- এটা অসত্য। কিছু মানুষ ইচ্ছে করে এই তথ্যটা ছড়াচ্ছেন। পুলিশকে হেয় করতে তারা এমনটা বলেন।

ট্রাফিক গুলশান বিভাগের বাড্ডা জোনের সার্জেন্ট রাকিবুজ্জামান রাকিব বলেন, চাকরির শুরুতেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের নির্দেশনা দিয়ে দেন। সড়কে ডিউটি করতে গেলে অনেক কিছু সহ্য করতে হবে, অনেক কিছু হজম করতে হবে। মামলা দেওয়ার পরে অনেকেই মনে করেন ট্রাফিক পুলিশ কমিশন পায়, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সড়কে যে পরিমাণ আইন অমান্য হয় সে তুলনায় মামলা হয় খুবই কম। কারণ গাড়ি আটকে চেক বা মামলা করা ছাড়াও সড়কে যান চলাচলকেন্দ্রিক আরও অনেক কাজ করতে হয়। রাজধানীতে বিশেষত অফিস শুরু ও শেষের সময়টাতে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতেই একটা বড় সময় কেটে যায়। এই সময়টাতে মামলা দিলে সড়কে চলাচলে ব্যাঘাত ঘটবে।