এমপি আনারের বন্ধু গোপালকে নিয়েও দানা বাঁধছে সন্দেহ

বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারের হত্যাকাণ্ডে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। কিন্তু আনার খুনের পর থেকেই গোপাল বিশ্বাসকে নিয়েও সন্দেহ দানা বাঁধছে। কারণ নিখোঁজ হওয়ার আগে তার বাড়িতেই উঠেছিলেন এমপি আনার।

গত ১২ মে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার অন্তর্গত মন্ডলপড়া লেনে অবস্থিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন তিনি। পরের দিন অর্থাৎ গত ১৩ মে ডাক্তার দেখানোর নামে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। এরপর থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান আনোয়ারুল আজীম আনার।

গত প্রায় দশদিন নিখোঁজ থাকার পর কলকাতার পার্শ্ববর্তী শহরাঞ্চল রাজারহাট নিউটনের বহুতল আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেনসে বিইউ ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটেই ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে শ্বাসরোধ করে খুন করার খবর সামনে আসে।

আনোয়ারুল আজীম খুন হওয়ার পর থেকে বরাহনগর থানার অন্তর্গত মন্ডলপড়া লেনে গোপাল বিশ্বাসের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে গেলে কখনো বলা হচ্ছে তার শরীর খারাপ তিনি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন আছেন, আবার কখনো বলা হচ্ছে তিনি বাড়িতে নেই।

তবে গোপাল বিশ্বাস সম্বন্ধে মন্ডলপাড়া লেনের বাসিন্দারা কোনো রকম মুখ খুলতে চাইছে না। গোপাল বিশ্বাসের নাম সোনা মাত্রই অনেকেই বলে উঠছে কে গোপাল চিনি না, কেউবা বলছে সোনার ব্যবসায়ী গোপাল? তার সম্বন্ধে আমরা কিছু বলতে পারব না। কেউবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলছে আমরা গোপাল বলে কাউকে চিনি না। খোঁজ করে দেখুন হয়তো আশেপাশে কোথাও আছে।

জানা গেছে, কলকাতার পার্শ্ববর্তী বরাহনগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাস পেশায় সোনা ব্যবসায়ী। তিনি সোনা কিনে গহনা তৈরি করে বিদেশে এক্সপোর্ট করেন। এছাড়াও গোপাল বিশ্বাসের নদীয়া জেলার গেদে বানপুরে একটি ইটভাটা আছে।

বরাহনগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাস তার এলাকার লোকজনের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করতেন না। খুব কম কথা বলা মানুষ তিনি। গোপাল বিশ্বাস সচরাচর বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে বাড়ির বাইরেও খুব একটা বের হতেন না। এমনটাই জানিয়েছেন মন্ডলপাড়া লেনের বাসিন্দারা।

এদিকে গণমাধ্যমে এমপি আনারের খুন হওয়ার খবর জানতে পেরে গোপাল বিশ্বাস প্রচণ্ড মর্মাহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। শুক্রবার ২৪ মে সকালে তার বাড়িতে গেলেও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর দফায় দফায় একাধিকবার চেষ্টার পর ফোনে পাওয়া গেলে গোপাল বিশ্বাস জানান হৃদরোগ ও অ্যালার্জির সমস্যা নিয়ে তিনি এই মুহূর্তে সল্টলেকের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি আছেন। তিনি বলেন, আমাকে পুলিশের কর্মকর্তারাও গণমাধ্যমের সঙ্গে মুখ খুলতে নিষেধ করেছেন।

যদিও অনেক অনুরোধের পর তিনি বলেন, এই ঘটনার পর আমি এমনি মর্মাহত হয়ে পড়েছি। গতকাল আমি সব টেলিভিশন দেখেই জানতে পারলাম এই ধরনের একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গেছে।

গোপাল বিশ্বাস বলেন, আমি যখন এই ঘটনা প্রথম টিভিতে দেখে জানতে পারলাম তখন আমার চোখ থেকে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আমি না কাঁদলেও আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি ভাবতেই পারছি না এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।

কিন্তু কেন আনারকে খুন করা হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে গোপাল জানান উনার মতো একজন মানুষকে মেরে ফেলতে পারে, এমন ধারণা আমার কোনদিনই ছিল না। কারণ আমি জানি উনার কোনো শত্রু নেই। উনি কোনো ঝামেলায় থাকেন না। কেন এই ধরনের একটা মানুষকে খুন করা হলো? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না।

গোপাল বিশ্বাস বলেন, এই ঘটনা ঘটার পর তদন্তকারী কর্মকর্তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তারা আমাকে সঠিক তথ্য পরিবেশনের কথা জানান এবং পুলিশের পরামর্শে নতুন করে আরেকটি অভিযোগ পত্র জমা দেন থানায়। বরানগর থানার পুলিশের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ (আইবি), এসবি, সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারাও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে।

তার দাবি, আমি যদি জানতে পারতাম এ ধরনের ঘটনা ঘটবে, তাহলে কি আর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করতাম। আমি যখন এই খুনের ঘটনা জানতে পারলাম, তারপরই আমি বরানগর থানায় গিয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করি।

এমপি খুনের পর অনেকেই গোপাল বিশ্বাসের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে গোপাল বলেন, আমাকে যদি কেউ দোষারোপ করে, আমার এতে কিছু বলার নেই। আমি নির্দোষ। আমি জীবনে কোনদিন কারো ক্ষতি করিনি। এসব বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। আমি কোনো ঝামেলায় থাকি না। আমি ব্যবসা করি, আমার কোনো অভাব নেই। আর আমি কেনই বা এর মধ্যে জড়াবো?

আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি… প্রশাসন যদি মনে করে তাহলে আমাকে ধরবে। নিজের একজন কাছের মানুষকে যদি বাড়িতে রাখা পাপ হয়। তাহলে আর কিছু বলার নেই।

এমপি আনারের প্রশংসা করে গোপাল বলেন, উনি (আনার) আমার উপকার ছাড়া অপকার করেননি। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার মাজদিয়ার বাসিন্দা সুভাষ আগরওয়ালের মাধ্যমে এমপি আনারের সাথে আমার পরিচয় হয়। এছাড়া উনি যে সেদিন নিজে আমার বাড়িতে আসবেন, সেটাও আমি জানতাম না।

উনি আমাকে গেদে থেকে ফোন করে বলল, আমি গেদে থেকে আসছি এবং সুভাষ দার (আনারের পূর্ব পরিচিত সুভাষ আগরওয়াল) মাঝদিয়ার বাড়িতে যাব। উনি নিজেই সুভাষকে ফোন করেছিলেন এবং সুভাষ জানান তার মেয়ের ছেলে হয়েছে। সে কারণে তিনি বাড়িতে নেই। এরপর তিনি আমার বাড়িতে এসে উঠেন।

চিকিৎসা করাতেই এই সংসদ সদস্য কলকাতায় এসেছিলেন বলে দাবি করেন গোপাল বিশ্বাস। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কোনো রকম আলোচনাও করেনি এবং সেই সময়ও পায়নি। তিনি আমার বাড়িতে আসলেন, আবার পরের দিনই সেখান থেকে চলে গেলেন। আমি তাকে শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলাম তুমি কিসের জন্য এই সময় কলকাতায় এসেছো, তখন আমাকে বলল ডাক্তার দেখাতে হবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার কি সমস্যা হচ্ছে? উত্তরে আমাকে বলল, স্নায়ুরোগের ডাক্তার দেখাতে হবে। তখন আমি তাকে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেই।

তিনি বলেন, এরপর তিনি আমাকে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলেন। আমার বাড়ির কাছে বিধান পার্কে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করা হয় এরপর শুভজিৎ মান্না নামের এক ব্যক্তি তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসেন। সেদিন বিকেল বেলা ডাক্তার দেখিয়ে গোপালের বাড়িতে ফিরে আসার কথা থাকলেও তিনি দিল্লি চলে যাচ্ছেন বলে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠান ওই আনোয়ারুল আজীম। তারপর থেকেই বেশ কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর তার খুনের খবর সামনে আসে।