চাকুরী ছেড়ে কৃষিতে নারী উদ্যোক্তা জেসমিন রোজ, মাসে আয় ৫০ হাজার টাকা

বিভিন্ন দেশে এমবিএ চা ওয়ালা, এমবিএ ফুচকা ওয়ালা, ইঞ্জিনিয়ারের চায়ের দোকান ইত্যাদি ইত্যাদি চোখ ধাঁধানো সংবাদ ভাইরাল হয়। কখনো এমবিএ গুঁড়, পাটালী বিক্রেতার কথা শুনেছেন কি? তাও আবার নারী! চলুন অজানা সেই তথ্য জানার চেষ্টা করি।

প্রবাদ আছে, “কারও পৌষ মাস , কারও সর্বনাশ”। করোনা মহামারীতে সবেচেয়ে চাঙ্গা ছিলো কৃষি খাত। সব কিছু থেমে গেলেও থামেনি কৃষি উৎপাদন। এই অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে নিয়েছেন। কেউ বা হয়েছেন ব্যর্থ তবুও কৃষিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন।

যশোর সদরের কারবালা সি এন্ড বি রোড এলাকার মেয়ে জেসমিন রোজ । কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট এ এমবিএ শেষ করে হয়েছেন নারী উদ্যোক্তা। খেজুর গুঁড়, পাটালী, সরিষার তেল ও খাঁটি মধু বিক্রি করেই তিনি প্রতি মাসে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন।

পরিসংখ্যান ব্যুরো কি বলছে?

চলতি বছরেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস জানিয়েছিলো যে ,এক দশকের ব্যবধানে নারী উদ্যোক্তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে-২০২০ এর জরিপ ফল প্রকাশ করে বলা হয়েছিলো যে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিলো দু লাখেরও বেশি যা ২০০২-০৩ অর্থ বছরে ছিলো মাত্র ২১ হাজার।

এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা করছেন আরও কয়েক লাখ উদ্যোক্তা।

নারী হিসাবে শুরুটা যেভাবে:

নারী উদ্যোক্তা জেসমিন রোজ জানান, “ ম্যানেজমেন্টে এ এম,বি এ শেষ করে সরকারী চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। স্বপ্ন দেখতাম আমিও চাকরি করব, নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবো। বাবা মা চাইতো মেয়ে বড় চাকুরি করবে। চাকুরি আমার করতেই হবে। সব সময় মনে হতো কবে একটা চাকুরি পাবো। বাবা মাকে কে খুশি করবো। আসলেই চাকুরির খুব প্রয়োজন ছিলো।কেন না পড়াশোনা শেষ করার পরও বাবা মায়ের কাছে হাত পেতে টাকা চাইতে খারাপ লাগত। ভাবতাম আর কত টাকা নিবো। বিভিন্ন জায়গাতে পরীক্ষা দিতে দিতে হঠাৎ আমার একটা প্রাইভেট কোম্পানি তে চাকুরি হয়ে যাই।, আলহামদুলিল্লাহ ২০১৯ সালের নভেম্বর এ জয়েন করি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ২০২০ সালের মার্চ মাসে এসে আমার অফিস বন্ধ হয়ে যাই।তার পর থেকেই আবার হতাশা কাজ করে, আবার তো সেই বেকার হয়ে গেলাম কি করবো। কিছুই ভাল লাগে না। সারাদিন ফেসবুকে সময় কাটাই। পড়াশোনাতেও মন বসে না। মনে হত ছেলে হয়ে জন্মালে হয়ত অনেক কাজ করতে পারতাম। হতাশায় দিন পার করতাম। সব সময় মনে হতো কি করবো আমি??? নিজের বলার মতো একতা গল্প ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার এর একটি কথা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। স্বপ্ন দেখুন, সাহস করুন, লেগে থাকুন, সফলতা আসবেই।

নারী হিসাবে পণ্য বিক্রি চ্যালেঞ্জিং:

জেসমিন রোজ বলছিলেন, “আমি একটা ফেসবুক আইডি খুলি ফেইক যাতে আমার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন না থাকে না জানে যে আমি এত শিক্ষিত হয়ে এখন কাপড় এবং ঘি মধু তেল বিক্রি করে থাকি। এমনকি আমি নিজেও কাউকে বলতাম না যে আমি অনলাইনে বিজনেস করি। আমার মা অনেক অপছন্দ করতো। আমি আমার মাকে বোঝাতে থাকি এবং স্যারের ভিডিও গুলা দেখাতে থাকি এবং বোঝাতে থাকি এখানে বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু চাকরি র পাশাপাশি বিজনেস করে। আমাদের ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমি আমার মাকে নিয়ে যেতে থাকি। অনেক অনেক ভাই বোনদের সাথে পরিচিত হয় এবং এ সব বিষয় গুলা মায়ের অনেক অনেক বেশি ভালো লাগে। ব্যাচ বিশ্বাস করেন তারপর থেকে আমার মায় ই ফাউন্ডেশনের প্রেমে পড়ে যাই। তারপর নিজ জেলার বিখ্যাত পন্য কি খুঁজতে থাকি তারপর আমি ঠিক করি আমাদের যশোরের ঐতিহ্যবাহি পন্য নিয়েই কাজ করবো। তখন সময়টা ছিল শীতকাল। আমাদের যশোরের ঐতিহ্যবাহি খেঁজুরের গুড় পাটালি নিয়ে কাজ শুরু করি । কিন্তু সেটা গোপনে। কারন ফ্যামেলি থেকে কখনোই সার্পোট করবে না। এবং প্রথমে কোন সার্পোট করে ও নি। আমি যখন গুড় পাটালি নিয়ে কাজ শুরু করি, আমার আম্মু হাত থেকে নিয়ে টেনে ফেলে দেই। আর বলে এত পড়া শোনা করে আমি কিনা গুড় পাটালি বেঁচবো? অনেক পরিশ্রম করেছি একা একা। খেঁজুরের গুড় পাটালি নিয়ে কাজ করাতে আলহামদুলিল্লাহ অনেক সাড়া পেয়েছি। খেঁজুরের গুড় পাটালি ছিলো আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। “

পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও বিশ্বস্ততা তৈরি:

কাকডাকা ভোরে নিজে স্কুটি চালিয়ে সরাসরি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে চাষীর মাধ্যমে খেজুর রস সংগ্রহ করে গুঁড় ও পাটালী বানানোর সমস্ত প্রক্রিয়া মুঠোফোনে ধারণ করে তার ফেসবুক আইডি ও বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করতেন বলে জানান জেসমিন রোজ । সেখান থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ক্রেতা। এক সময় অবস্থা এমন হয়ে যায় যে ক্রেতার চাপ সামলাতে পারতাম না। একবার যেখানে পণ্য যেত সেখান থেকে বার বার অর্ডার আসতো।

কৃষি পণ্যের দিকে ঝুঁকলেন যে কারণে:

খাঁটি পণ্যের নিশ্চয়তা, সরাসরি নিজে তদারকি করতে পারি এবং পণ্যের শতভাগ মান নিয়ন্ত্রণ হয়। অন্যদিকে প্রান্তিক কৃষক লাভবান হয় কিছুটা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে পেরে। কৃষি পণ্য নিয়ে কাজ করলে মনে হয় প্রকৃতির সাথে মিশে আছি। প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে ভালোলাগা, ভালোবাসা কাজ করে বলে জানাচ্ছিলেন জেসমিন রোজ।

সমাজ যেভাবে দেখে:

আমি উদ্যোক্তা হিসাবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। এখন আমার বাবা মা আমার সফলতা দেখে প্রচন্ড সাপোর্ট করে। আলহামদুলিল্লাহ। নিজের বলার মত একটি গল্প আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। অনেক রাগ অভিমান ছিলো আমার মধ্যে এবং অনেক অনেক ইগো ছিলো। কিন্তু সে সব আর কিছুই নাই আমার মধ্যে। নিজের বলার মত একটি গল্প আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে একজন ভালো মানুষ হওয়া যায়। এবং বাবা-মাকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। সব সময় পজিটিভ থাকতে শিখিয়েছে। মানুষের জন্য কাজ করলে নিজের খাদ্যের অভাব হয় না। এছাড়া আরও বিভিন্ন স্কিল যে গুলো উদ্যোক্তা এবং কর্পোরেট দৈনিন্দিন জীবনে সহায়তা করেছে । যা আমার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় বলছিলেন জেসমিন রোজ।

মাসিক আয় এবং পণ্য তালিকা:

জেসমিন রোজ বলেন , উদ্যোক্তাদের মাসিক আয় বলা মুশকিল। প্রথম যখন গুঁড়, পাটালী, মধু, ঘি ও সরিষার তেল বিক্রি শুরু করেছিলাম তখন প্রথম মাসে তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত সেল করেছি। এখন নতুন কিছু গার্মেন্টস প্রোডাক্ট যুক্ত করেছি। সব মিলিয়ে এখন মাসে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় হয়।

বর্তমানে দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ আসে নারী উদ্যোক্তাদের হাত ধরে। পরিসংখ্যান বলছে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও দক্ষতা উন্নয়ন মূলক প্রশিক্ষণ জোরদার, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক নারীদের উন্নয়নে বিশেষ প্রকল্প প্রণয়ন, সল্প সুদে ঋণ ব্যবস্থা চালু করা সহ বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ পরিচালনা করতে পারলে সমাজের অবহেলিত নারীরা মোট জিডিপির ১২-১৫ শতাংশে উন্নীত করতে ভূমিকা রাখবে।