থামেনি, উল্টো বেড়েছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ : প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা

থামেনি, প্রশাসনে উল্টো বেড়েছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। অন্যদিকে অনেকে যোগ্য হওয়ার পরও পাচ্ছেন না পদোন্নতি। প্রশাসনে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতির পরও নিচের পদে কাজ করতে হচ্ছে।

চলতি মাসেই শুধু সচিব পর্যায়ে দুজন কর্মকর্তা চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন। এভাবে সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তারা অবসরের পরও চাকরিতে ফিরছেন। এতে প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে ও বিশৃঙ্খলা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়স ৫৯ বছর। আর মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স ৬০ বছর। একজন প্রশাসন বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশেষায়িত ও কারিগরি পদের ক্ষেত্রে যেখানে দক্ষ লোকের সংখ্যা খুবই কম সেখানে শুধু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে, যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তারা কেউই ওইসব পদে অপরিহার্য নন।

চলমান চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করে ২০১৪ সালের ১ মার্চ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী, কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টায়নি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের স্পিরিটটা হলো, যেখানে কর্মকর্তার উপযুক্ত রিপ্লেসমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না, বিশেষ করে টেকনিক্যাল পোস্টের ক্ষেত্রে, সেখানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যায়। কিন্তু এখন হলো ফেভার ডিস্ট্রিবিউন, যাকে পছন্দ হয় চুক্তিতে রেখে দেই, যাকে পছন্দ হয় না বিদায় করে দেই।’

‘টেকনিক্যাল পোস্ট, কর্মকর্তা পাওয়া যায় না, এসব চিন্তা করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয় না’ বলেন সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল হাফিজ উদ্দিন।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বহুবিধ ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এখন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মূল শর্ত হলো দলীয় মনোভাব, দলীয় আনুগত্য। এটা প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট করে। অনেকের প্রমোশনের পথ ব্লক হয়ে যায়, এটা কর্মকর্তাদের হতাশ করে।’

সরকার বিভিন্ন সময় বড় ধরনের পদোন্নতি দিলেও এখনও প্রশাসনে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত রয়েছেন। পদোন্নতির বঞ্চনা প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারে বেশি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার ব্যাচের ২০ জনকে পদোন্নতি দিলেও সেখানে আমার নাম থাকার কথা। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব পদে দু-তিন দফা পদোন্নতি হলো, কিন্তু আমি বঞ্চিত হলাম। আমার অপরাধ আমার জানা নেই।’

তথ্য ক্যাডারের একজন সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমার ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই যুগ্ম-সচিব। কিন্তু আমার পদোন্নতি হয়নি, সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তায় আটকে আছি। আমার পদমর্যাদা সিনিয়র সহকারী সচিবের সমান। এটা খুব হতাশ করে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বিগত সময়ে পদোন্নতির কারণে এখন প্রশাসনে নির্ধারিত পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বেশি। পর্যাপ্ত পদ না থাকায় পদোন্নতির পর অধিকাংশ কর্মকর্তাকেই আগের জায়গায় কাজ করতে হচ্ছে। ফলে একেক মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব রয়ে গেছেন। কোন কোন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে একটি মাত্র অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদ থাকলেও সেখানে তিন-চারজন অতিরিক্ত সচিব দায়িত্ব পালন করছেন। এতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনে।

অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পদগুলোর পুনর্বিন্যাস করা হয়। আগে উপসচিবরা যে পদে দায়িত্ব পালন করতেন, সেটাকে এখন উপসচিব বা যুগ্ম সচিব বলা হচ্ছে। আর যুগ্ম সচিব পদের বেলায় করা হয়েছে যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে প্রশাসনের এ বিশৃঙ্খলাকে আরও বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন ওই কর্মকর্তা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনেকেই মন খারাপ করে। জুনিয়ররা খুবই মন খারাপ করে। কিন্তু যে কন্ট্রাক্ট (চুক্তিতে নিয়োগ) পায় সে খুশি হয়, কন্ট্রাক্টের জন্য যে তদবির করে সে লাভবান হয়।’

তিনি বলেন, তবে সরকার কারো কারো ক্ষেত্রে মনে করে তার কিছু কোয়ালিটি আছে, সরকারের কাজে লাগবে। এজন্য হয়তো সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করে। এভাবে যে নিয়োগ দেয়া হয় সেটি আমি সমর্থন করি। এ সিনিয়র সচিব আরও বলেন, কিন্তু কন্ট্রাক্টের জেনারেল প্রিন্সিপালকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করি এবং বাইরের মানুষের যে মতামত তাতে মনে হয় তারাও এটা অপছন্দ করে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২৬ আগস্টের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনে ৪৬০ জন অতিরিক্ত সচিব, ৮০২ জন যুগ্ম-সচিব ও এক হাজার ৫৫৫ জন উপসচিব রয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদের সংখ্যা একশ’র কিছু বেশি। এছাড়া যুগ্ম সচিবের নিয়মিত পদের সংখ্যা সাড়ে চারশ ও উপসচিবের নিয়মিত পদ সাড়ে আটশ’র মতো।

এ বছর যারা চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন
অবসরে যাওয়ার পর গত ১৭ আগস্ট চুক্তিতে আরও দুই বছরের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ পান মো. শহীদ উল্লা খন্দকার। একই দিন দুই বছরের জন্য আবারও চুক্তিতে নিয়োগ পান স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতি গোলাম নাসির।

৭ আগস্ট চুক্তিতে দুই বছরের জন্য নিয়োগ পান আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক। যদিও এ নিয়োগ নিয়ে আদালতে রিট চলমান।

২৮ জুন সচিব পবন চৌধুরীর অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) বাতিল করে দুই বছরের জন্য তাকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদের চুক্তির মেয়াদ ২০১৯ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের চুক্তির মেয়াদ তিন বছর বাড়ানো হয়।

১ ফেব্রুয়ারি চুক্তিতে এক বছরের জন্য বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) চেয়ারম্যান হন অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন। একই দিন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খানের মেয়াদও চুক্তিতে দুই বছর বেড়েছে। আলী আহাম্মেদের পিআরএল বাতিল করে এ নিয়োগ দেয়া হয়।

এর আগে ২৫ জানুয়ারি চুক্তিতে আরও এক বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব নিয়োগ পান অবসরে যাওয়া সুরাইয়া বেগম।

চলতি বছরের ৩১ মে অতিরিক্ত সচিব হোসনে আরা’র পিআরএল বাতিল করে চুক্তিতে তাকে দুই বছরের জন্য বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সচিব পদমর্যাদায়) নিয়োগ দেয়া হয়।

এছাড়া চলতি বছর অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি ঘোষকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা জামিল আহমেদ আলিমের অবসরোত্তর ছুটি বাতিল করে এক বছরের জন্য পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) পদে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিসের (বিআইআইএসএস) বোর্ড অব গভর্নসের চেয়ারম্যান পদে মুন্সী ফয়েজ আহমেদ আবারও দুই বছরের জন্য নিয়োগ পান গত ৩১ মে।