ঠাকুরগাঁওয়ে ভূল্লীর শিক্ষক রবীন্দ্র দেবনাথ আত্মহত্যার নেপথ্যের কারণ

দারিদ্র্যের ছোবলে নীল হচ্ছে মানুষ। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সুদখোর, দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছে ব্ল্যাংক চেক এবং স্ট্যাম্প বন্ধক রেখে। এতে চেক ডিজঅনারের মামলায় পড়ছে। স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর থাকায় পড়ছে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও প্রতারণার মামলায়। এভাবে মামলায় জর্জরিত হচ্ছেন গরবী মানুষ। হামলা,মামলা এমনকি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে।

গত বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বাঁশঝাড় থেকে চরণখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্র দেবনাথ (৫৫) এর মরদেহ উদ্ধান করেন ভূল্লী থানা পুলিশ। ঋণের চাপ সইতে না পেরে তিনি ‘আত্মহত্যা’ করেছেন বলছে পুলিশ। তিনি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড়গাঁও ইউনিয়নের কেশুরবাড়ী তাঁতিপাড়া এলাকা বাসিন্দা।
স্কুলশিক্ষক রবীন্দ্র দেবনাথের ছোট ভাই কৃষ্ণ চন্দ্র দেবনাথ সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন দাদা বিকালে স্থানীয় একটি বাজারে যান। রাত ১০টার দিকে বাড়ির পাশে একটি বাঁশঝাড়ে দাদাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান প্রতিবেশীরা। দাদা বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। সেগুলো পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, সে কারণে হয়ত আত্মহত্যা করেছেন। তার মৃত্যু পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই বলে তিনি জানান। তবে কত টাকা ঋণ তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি নিহতের ছোট ভাই।
গতকাল শনিবার (২মার্চ) নিহতের ভাগিনা রাজিব দেবনাথ রাজু জানান, তাঁর মামা রবীন্দ্র দেবনাথের কোন ঋণ ছিলো না। তাঁর জমি-জায়গা অনেক। ঋণের করার কোন প্রশ্নেই আসে বলেন জানান তিনি।
একই পরিবারের দুই ব্যাক্তির দু’ধরণের বক্তব্যের কারণ খুঁজতে এই প্রতিবেদক কথা বলে স্থানীয়দের সঙ্গে। স্থানীয়রা বলছেন, রবীন্দ্র দেবনাথ ঋণগ্রস্ত ছিলেন। এনজিও’র লোক তাঁর বাড়িতে আসতো কিস্তির জন্য। টাকা না পেয়ে এনজিও কর্মীরা অপমান-অপদস্ত করে চলে যান। কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনি গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।

তারা আরো জানান, ঋণের পাশাপাশি ঠাকুরগাঁওয়ে সুদের কারবারে জড়াচ্ছেন দরিদ্ররা। এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ। বছরের পর বছর কিস্তি দিয়েও শোধ হচ্ছে না ঋণ। কিস্তির টাকা আদায়ের নামে দরিদ্র মানুষের ওপর চলে এনজিও-দাদন ব্যবসায়ীদের তাণ্ডব। এতে ওই শিক্ষকের মতো কেউ জীবন দিলেও তাদের দাপট কমে না। এলাকাবাসীরও ধারণা রবীন্দ্র দেবনাথ ঋণের গলায় দড়ি দিয়েছেন।

এই প্রতিবেদক কথা বলেন নিহতের কর্মস্থল চরণখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, দপ্তরি ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নরেশ চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। সেখানে মিলে ভিন্ন তথ্য।

স্কুলের দপ্তরি জানান, স্যার অনেক ঋণগ্রস্ত ছিলেন। প্রায় সময় দাদন ব্যবসায়ীরা স্কুলে আসতো টাকার জন্য। টাকা দিতে না পারলে তারা স্যারকে সবার সামনে অপমান করতো। তবে কত টাকা ঋণ তা জানতে চাইলে তিনি বলেন প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকা। আর সভাপতি বলেন, রবীন্দ্র দেবনাথের কাছে কিছু লোক টাকা পেতো। তিনি খুবই চাপে ছিলেন। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে তিনি অনেকের সাথে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। আমাকেও ডেকে ছিলো কথা বলার জন্য। কিন্তু আপসোষ শেষ কথা আর হলো না আমাদের।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক একবৃদ্ধ বলেন, এনজিও কর্মী ও দাদন ব্যবসায়ীদের চাপেই রবীন্দ্র দেবনাথ গলায় ফাঁস দিয়েছে। দাদন ব্যবসায়ী মমিন, হেলাল হোসেন, আসরাফ আলী, আতাউর ও জাহাঙ্গীর প্রতিনিয়তই হাট-বাজারে পথরোধ করে টাকার জন্য অপমান করতো। টাকা দিতে না পারলে সই করে ফাঁকা স্ট্যাম্প নিতো। এই দাদন ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা হয় হেলাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি টাকা পাবার কথা স্বীকার করে বলেন, নিহতের কাছে সাড়ে ৫ লাখ টাকা পাবেন তিনি। ২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর পঞ্চগড়ে জমির মামলা আছে বলে রবীন্দ্র দেবনাথ ও তাঁর স্ত্রী দুই মাসের শোধ করবেন মর্মে টাকা গুলো নেন।

তিনি আরো বলেন, আসরাফ আলী নামে একব্যাক্তি রবীন্দ্র দেবনাথের কাছে টাকা পেতো। সময় মতো টাকা না পাওয়ায় আসরাফ আলী ১৮ লাখ টাকা আত্নসাতের অভিযোগে আদালতে তিনটি মামলা দায়ের করেন। তবে এব্যাপারে আসরাফ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজী হননি।

সমাজ উন্নয়ন কর্মী মনিরুজ্জামান মিলন বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছরেও যদি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আত্মাহুতি দিতে হয়, মানুষ হিসেবে এর থেকে লজ্জার কিছু হতে পারেনা। ঠিক কতটা চাপে থাকলে একজন শিক্ষক, একজন বাবা এই পথ বেছে নিতে পারেন। মধ্যবিত্ত হয়ে জন্মানোটাই কি তবে আজন্ম পাপ? আমার মতে, ঋণের নামে রক্তচোষা এইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

ঠাকুরগাঁও আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক (সাবেক) অ্যাড. ইমরান হোসেন চৌধুরী বলেন, কেউ যদি কাউকে আত্মহত্যার প্ররোচিত বা মানসিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টিতে আসলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিজেই উদ্যোগী হয়ে মামলা করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ফয়জুর রহমান সাংবাদিকের বলেন, রবীন্দ্র দেবনাথ বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পেরে মানসিক চাপে ছিলেন। ঋন পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে চাপের মুখে তিনি হয়তো আত্মহত্যা করেছেন।

এ বিষয়ে ভূল্লী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল উদ্দীন বলেন, শিক্ষক রবীন্দ্র দেবনাথের পরিবার থেকে জানানো হয় তিনি ঋণগ্রস্ত ছিলেন। ঋণের চাপ সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। অভিযোগ না থাকায় স্কুল শিক্ষকের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান তিনি।