নয়ন-মিন্নির মোবাইল কোথায়?

বরগুনায় হত্যাকান্ডের শিকার রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে এ হত্যায় দায়ী করে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ঘটনার আগে-পরে অসংখ্যবার মিন্নি নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। রিমান্ড আবেদনেও তদন্ত কর্মকর্তা এমন কথাই বলেন। অথচ নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী বা মিন্নি, কারও মোবাইল ফোন এখনো জব্দই করতে পারেনি পুলিশ।

প্রযুক্তিগত আলামত হিসেবে দুটি জব্দ তালিকায় পাঁচটি মোবাইল ফোন ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হলেও এই তিনজনের কারও মোবাইলই সেখানে নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এই তিনজনের মোবাইল ফোন গেল কোথায়?

এদিকে নয়ন বন্ডের মায়ের দাবি অনুযায়ী ঘটনার পরদিনই পুলিশ তার বাড়িতে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার মেশিন (ওই মেশিনে ভিডিও সংরক্ষণের জন্য হার্ডডিস্ক লাগানো থাকে) ও কম্পিউটার নিয়ে আসে। ভাঙচুরও চালায় ঘরে।

ওই হার্ডডিস্কে ও কম্পিউটারে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আলামত থাকার সম্ভাবনা থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ওইসব যন্ত্রপাতি তারা পাননি। পুলিশ না আনলে গুরুত্বপূর্ণ ওই আলামতগুলো কে নিল, এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বরগুনা সদর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হুমায়ুন কবির।

বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) তিনি বলেন, এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা। অনেক আসামি। তাই আমরা দুটি জব্দ তালিকায় পাঁচটি মোবাইল ফোন ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি। এর মধ্যে একটি ফোন মিন্নির মায়ের বলে দাবি করেন তিনি। মোবাইল ফোনের সঙ্গে হত্যায় জড়িত ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের কিছু আলামত ও কিছু ফেসবুক আইডিও ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

স্থানীয়রা বলছেন, আসামি রিফাত ফরাজী সাত দিন পুলিশ হেফাজতে ছিলেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। এরপরও তার মোবাইল জব্দ না হওয়া সন্দেহজনক। আর নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

ক্রসফায়ার যেখানে হয়েছে, সেখান থেকে পিস্তল, রাম দাসহ নানা রকম অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। তবে মোবাইল উদ্ধার হয়নি। এটাও খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন স্থানীয় একজন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি।

এদিকে নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারের পর গণমাধ্যমকর্মীরা তার মোবাইল সম্পর্কে জানতে চাইলেও পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বলে জানান স্থানীয় একজন গণমাধ্যমকর্মী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বৃহস্পতিবার বলেন, পুলিশ শুরু থেকেই আমার মেয়েকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। তাই তারা তদন্ত তাদের সুবিধা মতোই করছে। এ জন্যই আমি পিবিআইয়ের তদন্ত চেয়েছি।

তিনি বলেন, তদন্ত শেষ না হতেই এসপি সাহেব বলে দিচ্ছেন আমার মেয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত। রিমান্ডে নিয়ে আমার মেয়েকে নির্যাতন করে জবানবন্দি আদায় করেছে। তাই পুলিশের এই তদন্তে আমি আর বিশ্বাস করি না। আমি চাই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মামলাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পিবিআইতে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।

গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে স্ত্রী মিন্নির সামনেই প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাত শরীফকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এ ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায় নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী রিফাত শরীফকে রামদা দিয়ে কোপাচ্ছে।
রিফাত ফরাজীর ভাই রিশান ফরাজী রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছে। স্ত্রী মিন্নি স্বামীকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে গেলেও তিনজন পুরুষের সামনে একা পেরে উঠতে পারছিলেন না। পরে গুরুতর আহত রিফাতকে ওইদিন বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

এ ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ ও পাঁচ-ছয়জনকে অজ্ঞাত আসামি করে বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় পুলিশ এ পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। গত ২ জুলাই ভোরে মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। পরে মিন্নিকেও রিফাত হত্যা মামলার আসামি করে গ্রেফতার দেখানো হয়।

গত ১৬ জুলাই সকাল পৌনে ১০টার দিকে রিফাত হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী মিন্নিকে জবানবন্দি গ্রহণের কথা বলে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে পুলিশ। সোয়া এক ঘণ্টা পর রাত ৯টার দিকে রিফাত হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখায়।

এরপর ১৭ জুলাই তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষ না হতেই ১৯ জুলাই তাকে আদালতে হাজির করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়। যদিও পুলিশি নির্যাতনের কারণেই এমন জবানবন্দি দিয়েছেন বলে আইনজীবীর কাছে জানিয়েছেন মিন্নি। তিনি এই জবানবন্দি প্রত্যাহারেরও পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

হাই কোর্টে রিট : বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যা মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বা সিআইডির তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। গতকাল হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ এ রিট করেন।

রিটে বলা হয়, স্থানীয় পুলিশ এমন স্পর্শকাতর মামলার তদন্ত করতে অভিজ্ঞ নয়। সুতরাং ন্যায়বিচারের স্বার্থে পিবিআই বা সিআইডির মাধ্যমে রিফাত হত্যা মামলারও তদন্ত করা হোক।

রিটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, আইন মন্ত্রণালয় সচিব, পুলিশের আইজি, বরিশালের ডিআইজি, বরগুনার পুলিশ সুপারসহ সাতজনকে বিবাদী করা হয়েছে।