পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ব্যক্তি মালিকানা জমিতে জোরপূর্বক রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে জোরপূর্বকভাবে সরকারি রাস্তা নির্মাণের লিখিত অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাটি উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের দলুয়াগছ গ্রামে ঘটেছে। গত মাসের ২৪ তারিখ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর জোরপূর্বকভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি আবাদী জমিতে রাস্তা তৈরি করার যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধে এই গণ অভিযোগ করা হয়।

গণ অভিযোগের পরেও অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্প সভাপতি রাস্তা তৈরিতে চল্লিশ দিন কর্মসূচির মহিলা দিয়ে মাটি ভরাটের চেষ্টা করলে চলতি মাসের গত মঙ্গলবার (২ মে) বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পঞ্চগড়ে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৪৪/১৪৫ ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। আবু বক্কর সিদ্দিক বাদী হয়ে ৮জনের নামে এই মামলাটি করেছেন। যার মামলা নং হচ্ছে এমআর ১৮২/২৩।

মামলার ২য় পক্ষরা হলেন, ওই ইউনিয়নের দলুয়াগছ গ্রামের মৃত কমিজ উদ্দিনের ছেলে তরিকুল ইসলাম(৪৫), হবিবর রহমান(৫০) ও মজিবর রহমান(৪৮), ফতুয়া পাড়া গ্রামের আকিম উদ্দীনের ছেলে মোজাফফর হোসেন (৪৫)(ইউপি সদস্য), মাঝ গ্রামের মৃত ছলিম উদ্দীনের ছেলে শের আলী(৩৯) (অত্র ইউপির গ্রাম পুলিশ), দলুয়াগছ গ্রামের তরিকুলের স্ত্রী সুলতানা বেগম(৩৮) একই গ্রামের মজিবরের স্ত্রী লতিফা বেগম(৪০) এবং উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের মালিগছ গ্রামের মসলিম উদ্দীনের স্ত্রী হালিমা বেগম(৩২)।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, উপজেলার ভজনপুর গের্দ্দ মৌজার জে.এল.নং ৩০ এর এস.এ ৩৭ নং খতিয়ানের এস.এ ৪৭৪ নং দাগের ১একর ৭শতক জমির উপর এলাকাবাসীর পক্ষে আব্দুস সাত্তার নামে এক ব্যক্তি গত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখ পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য কর্তৃক সুপারিশকৃত একটি লিখিত আবেদন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর পেশ করেন।

এরপর উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়ের গত ২০২০ সালের অক্টোবর মাসের ১ তারিখের ৩৩৯নং স্মারকের আদেশে এবং উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর গত ২০২০ সালের নভেম্বর মাসের ১ তারিখের ৮২৯ নং পত্রপ্রাপ্তির সাপেক্ষে ওই মাসের ১৯ তারিখের ১১৯ নং স্মারকে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, দাগটি জয়ন উদ্দিন গং পিতা হরফ আলী ব্যক্তি মালিকানাধীন নামে রেকর্ডভুক্ত রয়েছে। দাগটি ব্যক্তি মালিকানাধীন নামে রেকর্ডভুক্ত থাকলেও শ্রেণি রাস্তা উল্লেখ করা হয়েছে। দাগটি রাস্তা শ্রেণি হলেও কৃষি হিসেবে ওই গ্রামের ১১জন ব্যক্তি ব্যবহার করছেন। তদন্তকালে রাস্তার কোনো চিহ্ন পাইনি ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা। ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারা যায়, এই দাগটি কোনো খাস খতিয়ানেও উল্লেখ নেই।

অভিযোগ ও মামলা সূত্রে জানা যায়, এস.এ ৪৭৪ নং দাগটি রেকর্ডীয় মালিকসহ ওয়ারিশদের কাছ থেকে দলুয়াগছ গ্রামের মৃত আজিজুল হকের ছেলে আবু বক্কর ছিদ্দিক, মৃত মফিজ উদ্দীনের ছেলে সকিন আলী ও বাচ্চামদ্দীন, মৃত মসলিম উদ্দীনের ছেলে হকিকুল ইসলাম ও জিয়াউল ইসলাম, মৃত তমিরুল ইসলামের ছেলে ছামিউল আলম এবং মৃত আফসার আলীর স্ত্রী সুফিয়া বেগম ক্রয় সূত্রে মালিক হয়ে ১একর ৫শতক জমি প্রাপ্ত হন। এরপর হকিকুল ইসলাম, জিয়াউল ইসলাম, ছামিউল আলম, সকিন আলী ও সুফিয়া বেগম পাট, বাদাম, মরিচ ক্ষেত রোপন করেন এবং বাঁশঝার, সুপারী গাছ রোপন করেছেন। ৬২ রেকর্ডের পূর্বকাল থেকেই তাঁরা উক্ত দাগটি আবাদ করে আসছেন। ক্রয়কৃত মালিকগণ শান্তিপূর্ণভাবে আবাদ করাকালীন গত মাসের ৯তারিখ অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ এস.এ ৪৭৪ নং দাগের জমি জবর দখলের পাঁয়তারা করেন। এসময় মামলার ২য়পক্ষরা ১ম পক্ষ ও স্বাক্ষীগণকে জমি জবর দখলের বিভিন্ন ভয়ভীতি ও হুমকি ধামকি দেয়ার কথা বলেন।

এদিকে ব্যক্তি মালিকাধীন জমিতে অবৈধভাবে ইজিপিপি প্রকল্প দেয়ায় তাহার কাজ বন্ধে এলাকাবীসী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বরাবরে গত মাসের ২৪ ও ২৫ তারিখ একটি অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগের কোনো ফলাফল না পেয়ে ভুক্তভোগীগণ ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।

জানা যায়, প্রকল্প সভাপতি মামলার নোটিশকে তোয়াক্কা না করে নোটিশ পাওয়ার পরেও ওই রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ করিয়েছেন। আরোও জানা যায়, ঘটনার পর থেকে ওই রাস্তায় ৫ থেকে ৬দিনের উর্ধ্বে কোনো কাজ করেননি ইজিপিপি প্রকল্পের মহিলাগণ। এছাড়াও কাজের জন্য মহিলাদের নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি বিহীন ইউপি সদস্য মোজাফফর ব্যক্তি মালিকাধীন জমিতে সকলের অনুমতি ব্যতিরেকে লাল ঝন্ডা পতাকা চিহ্নিত করেছেন।

এতে এলাকাবাসী ক্ষোপ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানি কোন জমিতে লাল ঝান্ডা গাড়তে (টাঙানো) গেলে সরকারি আমিন (সার্ভেয়ার) ও তহশীলদার এবং নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু আমাদের এই আবাদী জমি গুলোতে ইউপি সদস্য কোন ক্ষমতায় লাল ঝান্ডা মাটিতে গাড়লেন। আমরা এর সঠিক বিচার চাই।

মামলার বাদী আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, ‘এই দাগটি আমাদের পৈতৃক মালিকদের কাছ থেকে ক্রয়কৃত সম্পত্তি। আমরা বর্তমানে ভোগদখলে নিয়ত আছি। হঠাৎ ইউপি সদস্য মোজাফফর ও তরিকুল রেকর্ডী ব্যক্তি মালিকাধীন এই জমিতে রাস্তা বাধার জন্য উঠে পড়ে লাগছে। তরিকুলদের ২ থেকে ৩টি পরিবার রয়েছে। দলুয়াগছ গ্রামের দু’পাশে দুটি সরকারি রাস্তা রয়েছে। আমরা গ্রামবাসীরা যেমন ওই দুই রাস্তা দিয়ে চলফেরা করি তারাও সেই রাস্তা দিয়েই চলাফেরা করছে। এসএ ৪৭৪ নং দাগটি কোনো খাস খতিয়ানে নেই। তবে খতিয়ানে শ্রেণির স্থলে করনিক ভুল হতেই পারে আদালতের মাধ্যমে এর সংশোধন রয়েছে।

দলুয়াগছ গ্রামের মৃত মফিজ উদ্দীনের ছেলে বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ সকিন আলী বলেন, ‘ওই দাগে আমার ১২শতক জমি ক্রয়কৃত রয়েছে। এছাড়াও এই দাগে আরো কয়েকজনের ক্রয়কৃত ৮৮ শতক জমি আছেন। আমরা সকলেই পাট, বাদাম ও মরিচ খেতের আবাদে নিয়ত আছি। আমার বুঝ থেকেই এই জমি আবাদে চাষাবাদ হয়ে আসছে। হাঠাৎ ইউপি সদস্য মোজাফফর ও তরিকুলরা জবর দখলে নিয়ে রাস্তা বানানোর পাঁয়তারা করছেন। আমি আপনাদের (সাংবাদিকদের) মাধ্যমে সরকারকে জানাতে চাই, যেই জমিতে কৃষি করা হচ্ছে এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি সেখানে রাস্তা বানাতে প্রকল্প দেয়া হল কিভাবে? আমরা এলাকাবাসী আবাদী এই জমিতে রাস্তার উদ্দেশ্যে মাটি ভরাটের কাজ বন্ধে ইউএনও মহোদয় বরাবরে অভিযোগ করেছি। অভিযোগ দেয়ার পরেও যখন প্রকল্প কমিটি ফসল নষ্টে ৪০দিন কর্মসূচির মহিলা পাঠিয়ে মাটি ভরাটের কাজ করার চেষ্টা করছেন। তাই নিষেধাজ্ঞার জন্য একটি মামলা করা হয়েছে।

২য় পক্ষের তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা আজ রাস্তা করতে দিচ্ছেনা তারাই চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাস্তার জন্য ইউএনও স্যারকে দরখাস্ত দিয়েছিলেন। তাহলে এখন রাস্তা হতে দিচ্ছেনা কেন এমন জিজ্ঞাসায় তরিকুল বলেন, তাঁরা আমার কাছ থেকে জমি বদল চেয়েছিলেন হকিকুলদের এই দাগে কোন দখল নেই, আমি কেন তাদের জমি বদল দিতে যাবো।’

ইউপি সদস্য মোজাফফর হোসেন বলেন, ‘ভজপুনর গের্দ্দ মৌজার ৪৭৪নং দাগটি এসএ ম্যাপে রাস্তা দেখানো আছে। রাস্তা করার জন্য পিআইও অফিস থেকে আমাকে প্রকল্প দেয়া হয়েছে। আমি প্রকল্পের মাধ্যমে ৪০দিন কর্মসূচির মহিলা দিয়ে মাটি ভরাট করছি। ৩ থেকে ৪দিন কাজ করার পর হকিকুলরা আমার মহিলাদের কাজ করতে দিচ্ছেনা। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে রাস্তা তৈরি করা কতটুকু গ্রহন যোগ্য হবে এমন জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, তাদের দলিল থাকলে তাঁরা(হকিকুলরা)এখনও কেন খারিজ করতে পারেনি। এখন তাঁরা(হকিকুলরা) খারিজ করতে পারবেনা। এটি রাস্তার জমি।

এদিকে উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিসের চুড়ান্ত প্রকাশনা সূত্রে জানা গেছে, এস.এ ৪৭৪ নং দাগের আরএস জরিপে ডঙ্গা শ্রেণিভুক্ত হাল ৫৫৪ নং দাগে ১একর ৭শতক জমি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ৫৫৪নং হাল দাগটি বিভিন্ন জনের নামে চুড়ান্ত ড্রাপ্ট পাবলিকেশন (ডিপি) করা হয়েছে।

দেবনগড় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আব্দুল গণি বলেন, ‘অফিসের খাস বহিতে ওই দাগের কোনো তালিকা নেই। দাগটি এস.এ রেকর্ডীয় মালিকানাধীন সম্পত্তি। শ্রেণির জায়গায় করণিক ভুল হতেই পারে সেটি সংশোধনের উপায় আছে। তবে বর্তমান আরএস জরিপে রাস্তা দেখানো হয়নি। দাগটি বিভিন্ন জনের নামে রেকর্ড হয়েছে।’

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ ছলেমান আলী বলেন, ‘ওই রাস্তায় আমি কোনো প্রকল্প দেয়নি। ইউপি সদস্য আর পিআইও অফিস উনারাই প্রকল্প দিয়েছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর প্রকল্পের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদ থেকে উভয়পক্ষকে ডেকে একটি সমাধান করে দিতে বলা হয়েছে। আমি মেম্বারকে আপাতত কাজ বন্ধ রাখতে বলছি। এখন যেহেতু তাঁরা আমার কথা না শুনে যে যার মতো চলতেছে আমি এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারছিনা।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা(পিআইও) জাকির হোসেন বলেন, ‘কাজ বন্ধে একটি অভিযোগ পেয়েছি। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহোদয়কেও অভিযোগ দেয়া হয়েছে। আপাতত প্রকল্পের সভাপতিকে ওই প্রকল্পে কাজটি বন্ধ রাখার জন্য বলা হয়েছে। অভিযোগকারী তাদের ক্রয়সূত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দাবি করেই অভিযোগটি দিয়েছেন।’

তেঁতুলিয়ার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদুল হক বলেন, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

অন্যদিকে তেঁতুলিয়ার চলমান দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘যেহেতু এস.এ জরিপের সময় রাস্তাটি রেকর্ডীয় মালিকের নামে সে অনুযায়ী ওই সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকদের। তবে খতিয়ানে শ্রেণির জায়গায় রাস্তা হয়েছে, যদি মনে করেন রেকর্ডীয় মালিকগণ মামলার মাধ্যমে শ্রেণি সংশোধন করতে পারে। এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি বিষয়টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে কোনো পক্ষ যদি ওই রাস্তার উপর মামলা করেন সেখানে যাওয়া বা কাজ করা ঠিক হবেনা। ইজিপিপি প্রকল্প দেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইজিপিপির দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের কিভাবে অভিযুক্ত রাস্তায় প্রকল্প দিলেন ইউনিয়ন পরিষদ সেই জবাব দিবেন।