পদ্মা সেতুতে রেল : আরেকটি স্বপ্ন পূরণের পথে বাংলাদেশ

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পর আরেক স্বপ্ন পূরণের পথে বাংলাদেশ। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে ঢাকা-ভাঙ্গা দ্রুতগতির রেলপথ এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। সড়ক পথের পর পদ্মা সেতু দিয়ে রেলপথ ব্যবহার সময়ের ব্যাপার মাত্র। চলতি মাসের শেষ দিকেই আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের টার্গেট রেখে খুঁটিনাটি কাজ চলছে। আর ৭ সেপ্টেম্বর রেলমন্ত্রীকে নিয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেন যাবে ভাঙ্গা।

প্রথম থেকেই ঢাকার কমলাপুর, গেন্ডারিয়া, মুন্সীগঞ্জের নিমতলা ও মাওয়া স্টেশন, শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পদ্মা স্টেশন, মাদারীপুরের শিবচর এবং ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা করতে পারবে। আর বাকি স্টেশনসহ ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার পথ জুড়ে চলছে বিভিন্ন ধাপের কাজ।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আফজাল হোসেন জানান, চলতি মাসের শেষ দিকেই আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের টার্গেট রেখে খুঁটিনাটি কাজ চলছে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার অংশের অগ্রগতি ৯০ শতাংশের বেশি।

পদ্মা সেতু ঘিরে দেশের নতুন রেল নেটওয়ার্কের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হতে যাচ্ছে ভাঙ্গা জংশন। এখানকার ১০টি রেল লাইনের মধ্যে ৬ টি লাইন চালুর পথে। আর ২২টি ভবনের মধ্যে ২১ টির কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে।

বর্তমান সরকারের যোগাযোগ অবকাঠামোর আরেকটি মেগাপ্রকল্প পদ্মা রেল সংযোগ। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। তবে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রকল্পের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এই অংশে ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইন বসানোর পুরো কাজ শেষ হয়েছে। তাই আগামী ৭ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল করবে। চলতি সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা রেলপথ উদ্বোধন করা হবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উদ্বোধনের সময় নির্ধারণের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে সূত্র।

প্রকল্প সূত্র জানায়, এর আগে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা-মাওয়া পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়েছে। এবার ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালানো হবে। এর জন্য চীন থেকে কেনা নতুন সাতটি কোচের একটি বিশেষ ট্রেন প্রস্তুত করা হচ্ছে। এটি আগামী ৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় কমলাপুর স্টেশন থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। এ ট্রেনে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, স্থানীয় সংসদ সদস্য, রেলওয়ের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীরা ভ্রমণ করতে পারবেন।

তবে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণসহ পদ্মা সেতু রেল সংযোগের পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত তিনটি অংশে রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার মেইন লাইন, ঢাকা-গেন্ডারিয়া পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার ডাবল লাইন, লুপ, সাইডিং ও ওয়াই-কানেকশনসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।

এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৮৫ শতাংশ, মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত ৯৬ শতাংশ ও ভাঙ্গা-যশোর পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। এতে মোট গিয়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো প্রস্তাব অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা। জি টু জি ভিত্তিতে প্রকল্পের অর্থায়নে করছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ সহায়তা দেবে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বাকি ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ টাকা ব্যয় হবে সরকারি ফান্ড থেকে।

২০১৮ সালের এপ্রিলে চীনের সঙ্গে চূড়ান্ত ঋণ চুক্তি হয়। এর দুই বছর আগে কমার্শিয়াল চুক্তি হয়েছিল। প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি।

রেলপথে থাকবে ২০ স্টেশন:

পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত ২০টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৪টি স্টেশনই হচ্ছে আধুনিক ও নতুন। পুরনো ছয়টি স্টেশনকেও আধুনিক ও যুগোপযোগী করা হচ্ছে।

কেরানীগঞ্জের ঘোষকান্দিতে প্রথম এলিভেটেড নতুন স্টেশন নির্মাণ প্রায় শেষ হয়েছে। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জের নিমতলী, শ্রীনগর ও মাওয়া স্টেশন নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায় রয়েছে। মাওয়া স্টেশনের পরে পদ্মা সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা স্টেশন।

পদ্মা স্টেশনের পরে শরীয়তপুরে শিবচর স্টেশন। এ ছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গায় উন্নত দেশের আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে ভাঙ্গা জংশন। ভাঙ্গা থেকে একটি লুপ লাইন ফরিদপুর সদর ও অন্য একটি লুপ লাইন যাবে নাগরকান্দা পর্যন্ত।

প্রকল্পের আওতায় নাগরকান্দায় স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এরপরে গোপালগঞ্জের মকসুদপুর ও মহেশপুরে নির্মিত হচ্ছে দুটি রেলস্টেশন। এ ছাড়া নড়াইলের লোহাগড়া, নড়াইল সদরে একটি করে স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে।

যশোরের জামদিয়া ও পদ্মবিলে দুটি নতুন স্টেশনের নির্মাণ কাজ চলছে। প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান ছয়টি রেলস্টেশন ঢেলে সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন। আর গেন্ডারিয়া ও ফরিদপুরের পুরনো ভাঙ্গা স্টেশন আধুনিক করে গড়ে তোলা হয়েছে। সংস্কার করা হচ্ছে তিনটি স্টেশন। সেগুলো হলো: গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি, যশোরের সিংগাই ও রুপদিয়া।

কমলাপুর থেকে গেন্ডারিয়া তৃতীয় ডুয়েলগেজ লাইন, ভাঙ্গা জংশনে ওভারহেড স্টেশন, কমলাপুরের টিটিপাড়ায় আন্ডারপাস, নড়াইলের তুলারামপুরে নতুন আন্ডারপাস এবং ভাঙ্গা স্টেশনে আন্ডারপাস নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।

এসব স্টেশনে আন্ডারপাসের মাধ্যমে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যাওয়া যাবে। মাওয়া, পদ্মবিল, কাশিয়ানি, রূপদিয়া স্টেশনগুলোতে অপারেশনাল সুবিধা বাড়ানো হয়েছে।

ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পথে এখন পদ্মা সেতু। ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতির ব্রডগেজ রেল লাইন বদলে দেবে দেশের অর্থনীতি। কাজ তদারকি করছে সিএসসি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রকল্পটির গুণগত মান সঠিক রেখে দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে।

প্রকল্প পরিচালক মো. আফজাল হোসেন জানান, ঢাকা-ভাঙ্গা প্রায় ৮২ কিলোমিটার অংশে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু করতে প্রস্তুত। আর যশোর পর্যন্ত রেল চলবে আগামী বছরের জুনে।