বড় জমায়েত রেখে রায় শুনতে যাবেন খালেদা

৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নেতা-কর্মীদের বড় জমায়েত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। রাজপথে জমায়েত রেখে ওই দিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় শুনতে আদালতে যাবেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ লক্ষ্যে কয়েক দিন ধরে সাংগঠনিক প্রস্তুতি চলছে। জেলা পর্যায়েও ওই দিন জমায়েত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার প্রিজন ভ্যানে হামলা ও পুলিশকে মারধরের ঘটনা, তারপর পুলিশের ধরপাকড়ের মুখে পড়েছে বিএনপি। ফলে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা কিছুটা বিব্রত এবং অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। যদিও বিএনপির নেতারা বলছেন, মঙ্গলবারের ঘটনা ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিকল্পিত একটি ফাঁদ। তাতে পা দিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার কর্মী-সমর্থকেরা।

মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত শুধু ঢাকায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলটির ১৬৭ জন নেতা-কর্মীকে পুলিশ আটক করেছে। গ্রেপ্তার এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। ফলে ৮ ফেব্রুয়ারি রাজপথে গণজমায়েতের প্রস্তুতিতে কিছুটা ছেদ পড়েছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সংবাদ ব্রিফিং করে বলেন, পুলিশের ওপর হামলাকারী ছিল মিছিলে অনুপ্রবেশকারী। তিনি বলেন, ‘আমরা যে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছি, শান্তিপূর্ণভাবে যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার চেষ্টা করছি, সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটাকে বিনষ্ট করবার জন্য কাজ করছে।’

৭০০ নেতাকে আমন্ত্রণ

বিএনপির সূত্র জানায়, দলের নীতিনির্ধারকেরা এখন বেশি মনোযোগী কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভা নিয়ে। তাঁরা যেকোনো মূল্যে এ সভা করতে চান। ৩ ফেব্রুয়ারি সভা ডাকা হয়েছে। সভার জন্য মিলনায়তন ঠিক করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ও জেলার প্রায় ৭০০ নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আছেন ১২ জন। দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ৮০ জন, নির্বাহী কমিটির সদস্য ৫০২ জন, ১২টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আছেন ২২ জন। এ ছাড়া বিএনপির ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি পদাধিকারবলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তাঁদের সভায় আসতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

দলের বৃহত্তর সাংগঠনিক পর্ষদ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির দিনব্যাপী এই সভায় সমাপনী বক্তব্য দেবেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারকেন্দ্রিক আন্দোলন ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দেবেন। ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার রায়ের আগে দলের বৃহত্তর ফোরামে তাঁর এই বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

কী ধরনের বক্তব্য আসতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘কী বক্তব্য দেবেন সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। এটুকু বলতে পারি, তাঁর বক্তব্যে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা থাকবে।’

কূটনীতিকদের সঙ্গে বসবেন খালেদা

দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার রায় সামনে রেখে দেশের ভেতরে-বাইরে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে বিএনপি। এ বিষয়ে নেতারা ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে প্রভাবশালী দেশগুলোর মনোভাব জানার চেষ্টা করছেন।

খালেদা জিয়া ৪ বা ৫ ফেব্রুয়ারি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। এর আগে মঙ্গলবার বিএনপির নেতারা ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

৮ ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ইতিমধ্যে দল ও জোটের বৈঠক করেছেন। শিগগিরই দলের স্থায়ী কমিটির আরেকটি বৈঠক ডাকা হবে। ওই বৈঠকে দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

দল পরিচালনা

দলীয় সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মামলার রায় ও নির্বাচন সামনে রেখে দলের ঐক্য ঠিক রাখার দিকে নজর দিয়েছেন নীতিনির্ধারকেরা। এ লক্ষ্যে মঙ্গলবার রাতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে বৈঠক হয়। এতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস, রুহুল কবির রিজভীসহ মহানগরের কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। এসব নেতার মধ্যে নানা বিষয়ে দূরত্ব আছে বলে দলে আলোচনা আছে। ওই বৈঠকে নেতাদের মিলমিশ করে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ফেরার পথে গয়েশ্বর রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, মামলায় সাজা হলে এবং খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে তাঁর অবর্তমানে দল কীভাবে পরিচালিত হবে, এর প্রাথমিক একটা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের দল চালানোর কথা। তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে। এই অবস্থায় স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নয়জন নেতা ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনা করবেন বলে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্য নেতারা হলেন মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন সরকার, তরিকুল ইসলাম, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

সহিংসতায় না জড়ানোর নির্দেশনা

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারে খালেদা জিয়ার সাজা হলেও রাস্তায় এখনই কোনো ধরনের সংঘাতে জড়াতে চায় না বিএনপি। দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, রায়ের পর দলীয় প্রধানের জেল-জরিমানা যা-ই হোক, এর বিরুদ্ধে দল নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ জানাবে, কর্মসূচি দেবে। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, খালেদা জিয়া সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতে কোনো ধরনের সহিংসতায় না জড়িয়ে রাজপথে সাহসিকতার সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।

বিএনপির নেতাদের মূল্যায়ন, নির্বাচনের প্রাক্কালে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলার রায় সরকারের দিক থেকে বড় ধরনের প্ররোচনা। এর উদ্দেশ্য বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে বেকায়দায় ফেলে নির্বাচনের বাইরে রাখা। যার প্রথম প্রক্রিয়া সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে আগামী সংসদ নির্বাচনের অযোগ্য করা এবং বিএনপিকে সহিংস প্রতিক্রিয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া। যাতে নির্বাচনের আগে নেতা-কর্মীদের নতুন-পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার করে মাঠছাড়া করার কাজ সহজ হয়। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার অবর্তমানে নির্বাচনে যাওয়া না-যাওয়ার প্রশ্নে বিভেদ সৃষ্টি করা।

মির্জা ফখরুল গতকাল সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, সরকারের তরফ থেকে এই উসকানিমূলক কাজগুলো শুরু হয়েছে, যাতে বিএনপি নির্বাচনে আসতে না পারে। বিএনপি ও বিরোধীকে বাদ দিয়ে একদলীয় নির্বাচন করার নীলনকশা বাস্তবায়নই এর উদ্দেশ্য।

বিএনপির নেতারা বলছেন, ৮ ফেব্রুয়ারি রাজপথে বড় জমায়েতের লক্ষ্যে কয়েক দিন ধরে তাঁরা যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, মঙ্গলবারের ঘটনায় তা হোঁচট খেয়েছে। তাঁদের দাবি, টেলিভিশনের ফুটেজ দেখে তাঁরা মঙ্গলবারের হামলায় জড়িতদের চিনতে পারেননি। একই পথে খালেদা জিয়া যতবারই আদালতে যাওয়া-আসা করেছেন, প্রতিবারই পুলিশ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে, পিটিয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উল্টো অবস্থানে দেখা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তো কোনো কর্মসূচি দিইনি। অথচ সরকার নিজে অস্থির হয়ে গেছে। এসব করা ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায়ও নেই।’

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর মূল্যায়ন হলো, মামলা, গ্রেপ্তার, এমনকি সেদিনের ঘটনা—এর সবকিছুই নির্বাচন ঘিরে। সরকারি দল তার ক্ষমতার প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায়, সরকারও আনতে চায়। তবে সরকার যেভাবে ডিকটেশন দেবে, সেভাবে। এটা বিএনপি কতটা গ্রহণ করবে, তা বলা মুশকিল।’ সূত্র : প্রথম আলো