ভারতে ‘বেড়াতে’ যাওয়া বাঘেরা কোথায়!

গত এক দশকে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে। এ সংখ্যা বাড়ানোয় নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারিভাবে বলা হলেও বনের মধ্যে নৌ চলাচল ও শিকারিদের অত্যাচারে বাঘের সংখ্যা বাড়েনি। প্রাণিবিদরা বলছেন, বাঘের আবাস, খাবার ও চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে তাদের সংখ্যা বাড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।

সর্বশেষ শুমারি বলছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা এখন সর্বসাকল্যে ১০৬টি। আর বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে পুরো সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১৭০টি। বাঘের সংখ্যা কম কেন- এমন প্রশ্নে ২০১৫ সালের বাঘ দিবসে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছিলেন, বাঘ ভারতে বেড়াতে গেছে। সেই বাঘ ফিরলো কিনা তার জবাব নেই কারোর কাছেই। যদিও মন্ত্রী বললেন, বাঘ বেড়েছে। এর মানে বেড়াতে যাওয়া বাঘ ফিরেছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি শুধু বলেন, বেড়েছে। আর প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, সর্বশেষ শুমারির দশ বছর পর আবারও শুমারি হলেই কেবল বলা সম্ভব বাঘ কমলো না বাড়লো।

বাঘের আবাস

বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। সুন্দরবনের ৬২ শতাংশ বনাঞ্চল বাংলাদেশের মধ্যে পড়েছে। এ বনের জল-স্থলে বাঘের জন্য রয়েছে প্রচুর বৈচিত্রপূর্ণ খাদ্য- হরিণ, বানর, কাঠবিড়ালি, গিরগিটি, শুশুক, ভোঁদড়, কুমির ইত্যাদি।

বনবিভাগের কর্মকর্তারা জরিপের তথ্য উল্লেখ করে বলছেন, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৪ হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাঘ বিচরণ করে। এদের বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র বাগেরহাটের কটকা, কচিখালী ও সুপতিসহ খুলনার নীলকমল, পাটকোষ্টা ও গেওয়াখালী এবং সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, দোবেকি ও কৈখালী এলাকা।

বাঘের সংখ্যা এখন কত

‘স্ট্যাটাস অব টাইগারস ইন দ্যা সুন্দরবন ল্যান্ডস্কেচ’ শীর্ষক বাঘ জরিপের প্রতিবেদনে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৩টি ও ভারত অংশের ৫টি অঞ্চলের মোট ছয় হাজার ৭২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার চিত্র উঠে এসেছে। এই শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে এখন বাঘের সংখ্যা মাত্র ১৮২টি। এরমধ্যে বাংলাদেশ অংশে ১০৬ ও ভারত অংশে ৭৬টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে।

বাঘের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ প্রায় অসম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ জামান বলেন, কয়েক স্তরের জরিপ ছাড়া কেবল একটা দু’টা পদ্ধতি ব্যবহার করে কী সংখ্যক বাঘ রয়েছে- তা নিরূপণ সম্ভব নয়। ফলে একেকবার একেকরকম তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালের যে জরিপ যার ভিত্তিতে ২০১৫ সালের প্রতিবেদন, সেটির আগে ২০০৪ সালে বন বিভাগ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় বাঘের পায়ের ছাপ গুনে জরিপ করেছিল। এতে বাঘের সংখ্যা এসেছিল ৪৪০টি। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে নতুন জরিপের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, আগের ওই জরিপটি যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করা হয়নি। ফলে আগের ওই বাঘের সংখ্যা সঠিক নয়। যদিও ২০০৬ সালে জুওলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় আরেকটি বাঘ গণনা হয়, যেখানে বাঘের সংখ্যা ছিল ২০০টি।

বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির বলেন, ‘২০১৩ সালের নভেম্বরে যে সার্ভেটি হয়েছিল, সেটি ২০১৫ সালে প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে নিয়মিত মনিটরিং করা, ক্যামেরা দিয়ে দেখা হয় কিন্তু ফল যদি অফিসিয়ালি বলতে হয় ২০১৫ সালেরটিই বলতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে যদি বাঘের টিকে থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সবধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় তবে সংখ্যা বাড়ার বিষয়টি পরবর্তী শুমারির পর জানা যাবে।’

বাঘ কি ফিরলো

২০১৫ সালের বাঘ দিবসের অনুষ্ঠানে বাঘের সংখ্যা কেন কম সেটি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছিলেন, ‘বাঘের সংখ্যা কম কারণ তারা ভারত বেড়াতে গেছে। ফিরে আসলে সংখ্যা ঠিক হবে।’ সেই বাঘগুলো দুই বছরেও ফিরেছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাঘের সংখ্যা বাড়ছে।’ কিসের ভিত্তিতে কত সংখ্যক বাড়লো বলে তিনি মনে করছেন জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি কেবল বলব বাঘের সংখ্যা বাড়ছে, কতটা বেড়েছে সেসব বলবেন প্রধান বনরক্ষক।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘বাঘ বাড়াতে চাই বললেই হবে না। বাঘের আবাসস্থল, খাদ্য, চলাচলসহ অনেকগুলো বিষয় নিশ্চিত করতে পারলেই এমন দাবি করতে পারব আমরা। যা আসলে গত তিন বছরে করে ফেলা সম্ভব হয়েছে বলে আমি মনে করি না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ জামান বলেন, ‘বাঘের লোকালয়ে আসার প্রবণতা বেড়ে গেলেই বাঘ বেড়েছে বলা যাবে না। যারা দাবি করছেন বাঘ বেড়েছে তারা ভুল করছেন এ কারণে যে, সায়েন্টিফিক শুমারি ছাড়া এবং যথার্থ প্রটেকশন না দিয়ে বাঘ বেড়েছে মুখে বলে দেওয়া যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ববর্তী শুমারির দশ বছর পার হওয়ার আগে শুমারি করেও লাভ নেই। কেননা, লার্জ এনিমেলের ক্ষেত্রে শাবক সংখ্যা অনেক কম।’

বাঘের সংখ্যা বাড়েনি কেন

২০০৯ সালে সরকার একটি ‘টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করে। ২০১০ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। যেখানে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে। এতে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশ প্রতি দুই বছর পর পর বাঘ গণনা করবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘আমাদের দেশে বাঘের শুমারিতে যে সংখ্যা আসে, ততটা খারাপ হয়তো সংখ্যা না। কিন্তু এটি টিকিয়ে রাখার জন্যও যে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে সেটি করা সম্ভব হয়নি বলেই বাঘের সংখ্যা বাড়েনি। বাঘের জন্য নিশ্চিন্ত একটি বনভূমি থাকার পরও সেটি সুরক্ষা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০১১ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশ যা অঙ্গীকার করেছিল তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে আজকে বাঘের সংখ্যা বাড়তির দিকে থাকতো। এমনকি যে বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলের কথা ছিল না, সেই বন দু’ভাগ হয়ে গেছে।’ এসব দিক বিবেচনায় রাখলে আগামীতে ভালো হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।-প্রতিবেদন বাংলা ট্রিবিউনের সৌজন্যে প্রকাশিত।