‘ভিশন’ কার উদ্ভাবন, আ.লীগ না বিএনপির?

সৌধ ইসলাম : এমন তর্ক-বিতর্ক জোরালো হয়েছে ভীষণভাবে। কেউ বলছেন তারা দেড় যুগ আগে ‘ভিশন’ আবিষ্কার করেছেন। এটা একমাত্র তাদেরই উদ্ভাবন। আর প্রতিপক্ষ বলছে, ভিশন শুধু তাদেরই ইউনিক আইডিয়া। আর কারো মাথায় এটা আসতেই পারে না। যারা এটা নিজেদের বলে দাবি করছেন, তারা মূলত চৌর্যবৃত্তি করেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে এখন ‘ভিশন’ শব্দটা ভীষণরকম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমনকি এর আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিয়েও চলছে রীতিমত বাকযুদ্ধ। দেশের অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় দুই রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় প্রধান দুই নেতা ইতোমধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন বিতর্কে। তারা কেউই কাউকে এ ব্যাপারে ছাড় দিয়ে কথা বলছেন না।

গেল ১০ মে সন্ধ্যায় ‘ভিশন বা রূপকল্প-২০৩০’ নামে রাষ্ট্র পরিচালনায় বিএনপির ভবিষ্যৎ মুলনীতির বিষয়বস্তু দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন দলটির প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। ‘রূপকল্প ২০৩০’ নামে প্রকাশিত বইটিতে পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪১। যেখানে প্রস্তাবনা আকারে ২৬৫টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।

প্রস্তাবনার উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, রাজনৈতিক আচরণের সংস্কার, অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংস্কার, অর্থপাচার রোধ ও স্বাস্থ্যখাত। একই সঙ্গে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার একটা ছকও আঁকা হয়েছে।

ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ২ ঘণ্টা ৩ মিনিট ধরে ৪১ পৃষ্ঠার ওই রূপকল্প-২০৩০ পাঠ করে শোনান। বেসরকারি কিছু রেডিও ও টেলিভিশন মিডিয়া তা সরাসরি (লাইভ) সম্প্রচারও করে। গোটা দেশবাসী তা দেখেন ও শোনেন।

বিএনপির রূপকল্প-২০৩০ ঘোষণা টিভির সামনে বসে দেখেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও। তারা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসনের রূপকল্প ঘোষণার আধা ঘণ্টার মধ্যেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

ধানমণ্ডিতে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ‘ভিশন ২০৩০’ নিয়ে বলেছেন, পরের মেধাস্বত্ব চুরি করা নৈতিক অপরাধ, এটা এক ধরনের রাজনৈতিক অসততা। একটি রাজনৈতিক দল কতটা দেউলিয়া হলে অপর একটি রাজনৈতিক দলের আইডিয়া এবং চিন্তা নির্লজ্জভাবে চুরি করতে পারে? বিএনপি ইমিটেট (অনুকরণ) করতে পারে ইনোভেট (উদ্ভাবন) করতে পারে না।

শুধু দলের সাধারণ সম্পাদকই নন, বিএনপির রূপকল্প-২০৩০ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামও। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, খালেদার রূপকল্প বা ভিশন শেখ হাসিনার অনুকরণ, এতে নতুনত্ব কিছু নেই। আর বিএনপির ভিশনকে ধাপ্পাবাজি বলে আখ্যায়িত করেছেন খাদ্যমন্ত্রী।

এসব প্রতিক্রিয়ার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরদিন ১১ মে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এজন্য সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেখানে মহাসচিব বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপিই প্রথম ভিশন পরিকল্পনা পেশ করেছিল। পরে আওয়ামী লীগ তা অনুসরণ করেছে। আওয়ামী লীগ ঈর্ষান্বিত হয়ে অরাজনৈতিক ভাষায় ভিশন-২০৩০ এর সমালোচনা করছে বলেও দাবি করেন।

আওয়ামী লীগ ভিশন দিলেও তা বাস্তবায়ন করে না, সে যোগ্যতা তাদের নেই- এমন দাবি করে বিএনপি মহাসচিব সমালোচনাকারী নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, কোনোকিছু গভীরভাবে খতিয়ে দেখে বিবেচনা করার মেধা ও যোগ্যতার অভাবে গৎবাঁধা মেঠো সমালোচনা করা তাদের পুরনো অভ্যাস।

তারা দলীয়করণ, লুটপাট, দুর্নীতি, অত্যাচার, অপশাসন আর গলাবাজি ও ধাপ্পায় লিপ্ত থাকে। তাদের দিনবদলের ঘোষণা এখন এক করুণ পরিহাসে পরিণত হয়েছে। এমন মন্তব্যও করেন বিএনপি মহাসচিব।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রূপকল্প-২০২১ এর পর দ্বিতীয়বারের মতো রূপকল্প-২০৪১ প্রণয়নের কাজ শুরু করছে। আর বিএনপি এর আগে সরকার মেয়াদের ইশতেহার ঘোষণার পর প্রথমবারের মতো দীর্ঘমেয়াদের রূপকল্প নিয়ে হাজির হলো জনগণের সামনে।

উভয় দলের নেতাদের দাবি পাল্টা দাবির মুখে দেশের রাজনীতিতে ‘ভিশন’ মূলত কোন দলের উদ্ভাবন তা অমিমাংসিতই থেকে যাচ্ছে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আরো বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। ভিশন আবিষ্কার নিয়ে দুই দলের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি আর পরস্পরকে আক্রমণ অব্যাহত থাকবেই- এটাই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিতে হবে মনে করছেন অনেকেই।

তবে দেশের বৃহৎ দুই দলের রূপকল্প বা ভিশন প্রণয়নকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এসব রূপকল্প সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন তারা।

লেখক: সংবাদিক


প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। আওয়ার নিউজ বিডি’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক।